নিউজ ডেস্ক:
হজরত আদম (আ.) তার শরিয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর তিনি হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা উভয়েই আল্লাহর জন্য নিজ নিজ কোরবানি পেশ করো। যার কোরবানি কবুল হবে, সে-ই আকলিমার পানি গ্রহণ করবে।’
মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম (আ.) এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। এ ঘটনাটি বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী সনদসহ বর্ণিত হয়েছে। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) একে পূর্বাপর ওলামায়ে কেরামের সর্বসম্মত উক্তি বলে আখ্যা দিয়েছেন। যখন জান্নাত থেকে হজরত আদম ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে এসেছেন, তখনকার কথা। সন্তান প্রজনন ও বংশবিস্তার আরম্ভ হচ্ছিল তাদের থেকে। প্রতি গর্ভ থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়েÑ এভাবে যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। তখন একশ্রেণীর ভাইবোন ছাড়া হজরত আদম (আ.) এর আর কোনো সন্তান ছিল না। অথচ ভাইবোন বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তাই আল্লাহ তায়ালা উপস্থিত প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে হজরত আদম (আ.) এর শরিয়তে বিশেষভাবে নির্দেশ জারি করেন, ‘একই গর্ভ থেকে যে যমজ ছেলে ও মেয়ে জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাইবোন গণ্য হবে। তাই তাদের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী ছেলের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে মেয়ে সহোদরা বোন গণ্য হবে না। তাই তাদের পরস্পর বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে।’ ঘটনাক্রমে হজরত আদম (আ.) এর এক ছেলে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোন ‘আকলিমা’ ছিল খুবই সুশ্রী-সুন্দরী। আর তার অপর ছেলে হাবিলের সহজাত বোন ‘গাজা’ ছিল তুলনামূলক কম সুন্দরী। বিয়ের সময় হলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহজাত অসুন্দরী মেয়ে কাবিলের ভাগে পড়ল। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রু বনে গেল। সে জেদ ধরল, আমার সহজাত বোনকেই আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে।
হজরত আদম (আ.) তার শরিয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর তিনি হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরা উভয়েই আল্লাহর জন্য নিজ নিজ কোরবানি পেশ করো। যার কোরবানি কবুল হবে, সে-ই আকলিমার পানি গ্রহণ করবে।’ হজরত আদম (আ.) এর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, যে সত্য পথে আছে, তার কোরবানিই কবুল হবে। সেকালে কোরবানি কবুল হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কোরবানিকে জ্বালিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যেত। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওই কোরবানি, যাকে আগুন গ্রাস করে নেবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৮৩)। আর যে কোরবানিকে আগুন জ্বালিয়ে দিত না, সেটাকে প্রত্যাখ্যাত গণ্য করা হতো। কোরবানির এ পদ্ধতি প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর যুগ অবধি সব নবীযুগে বলবৎ ছিল। হাবিল ভেড়া, দুম্বা, ইত্যাদি পশুপালন করত। সে একটি মোটাতাজা দুম্বা কোরবানি করল। কাবিল কৃষিকাজ করত। সে কিছু শস্য, গম, ইত্যাদি কোরবানির জন্য পেশ করল। এরপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কোরবানিটি জ্বালিয়ে দিল। কাবিলের কোরবানি যেমন ছিল, তেমনই পড়ে রইল। এ অকৃতকার্যে কাবিলের দুঃখ ও ক্ষোভ বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না। তাই হাবিলকে হত্যা করার ইচ্ছে করল। একপর্যায়ে তাকে হত্যা করেও ফেলল। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৩/১০১)।
হাবিল ও কাবিলের কোরবানির সেই ঘটনা পবিত্র কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘আপনি তাদের আদমের দুই ছেলের ঘটনাটি ঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। (তা হচ্ছে এই) যখন তারা উভয়ে কোরবানি পেশ করল, তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হলো। অপরজনেরটি কবুল করা হলো না। তখন সে (কাবিল) ভাইকে (হাবিলকে) বলল, অবশ্যই আমি তোমায় হত্যা করব। জবাবে অপর ভাই বলল, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন। যদি তুমি আমায় হত্যা করতে আমার প্রতি হাত বাড়াও, তবে আমি তোমায় হত্যা করতে তোমার প্রতি হাত বাড়াব না। নিশ্চয়ই আমি বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের কাঁধে নিয়ে দোজখিদের অন্তর্ভুক্ত হও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি। এরপর তার অন্তর তাকে ভাইয়ের হত্যায় উদ্বুদ্ধ করল। শেষাবধি সে তাকে হত্যা করে ফেলল। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত হলো। আল্লাহ তায়ালা এক কাক পাঠালেন। সে মাটি খুঁড়ছিল, যাতে তাকে শিক্ষা দেয়, আপন ভাইয়ের মৃতদেহ সে কীভাবে সমাহিত করবে। সে (কাবিল) বলল, আফসোস! আমি কি এ কাকের সমতুল্যও হতে পারলাম না, আপন ভাইয়ের মৃতদেহ সমাহিত করি! এভাবে সে পরিতাপ করতে লাগল।’ (সূরা মায়িদা : ২৭-৩১)। সেই থেকে প্রত্যেক উম্মতের মাঝে অবিচ্ছিন্নভাবে কোরবানির ধারাবাহিকতা চলতে থাকে।