নিউজ ডেস্ক:
প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার বাংলাদেশেই কম। গত তিন বছরে বাংলাদেশে যে হারে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। এ ছাড়া চীনে প্রকৃত মজুরি বাড়ছে অনেক বেশি হারে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ফ্ল্যাগশিপ’ প্রতিবেদন ‘গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট ২০১৬/২০১৭: ওয়েজ ইনইকুয়ালিটি ইন ওয়ার্ক প্লেসে’ বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে মোট ১১ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতে তা ১৬ দশমিক ৩, পাকিস্তানে ১১ দশমিক ১, ভিয়েতনামে ১২, কম্বোডিয়ায় ৪৪ দশমিক ৩ (দুই বছরে), থাইল্যান্ডে ১৬ দশমিক ৯ ও চীনে ২১ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বেড়েছে। তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নেপাল, ফিলিপাইনসহ কিছু দেশে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে বাংলাদেশের চেয়ে কম হারে।
প্রকৃত মজুরি হিসাব করা হয় একটি দেশের মজুরি বৃদ্ধির হারের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করে। এটাকেই একজন কর্মজীবীর প্রকৃত আয় বৃদ্ধি হিসেবে গণ্য করা যায়। প্রকৃত মজুরি উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়লে কর্মজীবীর জীবনযাত্রার মানে কোনো পরিবর্তন আসে না।
আইএলওর প্রতিবেদনটি গত ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পরে ২০১০ সাল থেকে বৈশ্বিক প্রকৃত মজুরির হার আবার বাড়তে শুরু করে। তবে বৈশ্বিক প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির গতি ২০১২ সালের (২.৫%) তুলনায় ২০১৫ সালে (১.৭%) অনেকটাই কমে গেছে, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে মজুরি বৃদ্ধির হার কমেছে। বিপরীতে উন্নত দেশগুলোতে মজুরি বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি হারে।
আইএলও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সরবরাহ করা বিভিন্ন দেশের মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিয়ে নিজেরা প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার হিসাব করেছে। কর্মজীবী হিসেবে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাঁরা অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন (পেইড এমপ্লয়মেন্ট জব), যাঁদের মূল বেতন প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসানের ওপর নির্ভর করে না। নিয়মিত, খণ্ডকালীন, নৈমিত্তিক, মৌসুমি ও অন্যান্য শ্রেণির কর্মীরা এর অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশ যে অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত, সেই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গত তিন বছরে মজুরি বেড়েছে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৫ সালে এ অঞ্চলে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ৪ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে ২০১৩ সালে গড় মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। পরবর্তী দুই বছরে ২ দশমিক ৪ শতাংশ হারে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে আইএলওর প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকের বড় অংশ কৃষি খাতনির্ভর, আরেকটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। এ কারণে মজুরি যতটা বাজারভিত্তিক অথবা ‘রেগুলেটেড’ হারে বাড়ার কথা, বাংলাদেশে তা হয়নি। প্রতিবেশী ও অন্য দেশগুলোতে হয়তো শ্রম খাত আরও আনুষ্ঠানিক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে প্রধান কয়েকটি খাতে মজুরি সমন্বয় হয়েছে। অন্যান্য দেশে হয়তো নিয়মিত সমন্বয় করা হচ্ছে। যেমন ভারতে প্রতিবছরই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় হয়ে থাকে। এর ফলে এসব দেশে মজুরির একটি স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়ে থাকে। আরেকটি কারণ হতে পারে, অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি কম।
বাংলাদেশে এখন গড় মজুরি কত বা কোন খাতে কর্মী ও শ্রমিকেরা কত মজুরি পান, তা আইএলওর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। তাই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনামূলক চিত্রটি বোঝা যাচ্ছে না। তবে সংস্থাটির আরেকটি প্রতিবেদনে পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি হারের একটি চিত্র পাওয়া যায়।
‘পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি-২০১৫’ শীর্ষক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি মাসে ৬৮ ডলার, ভারতে ৭৮ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ৯২ ডলার, পাকিস্তানে ৯৯ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১২৮ ডলার ও মালয়েশিয়ায় ২২৫ ডলার।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে মজুরির পরিমাণই কম। এই মজুরি যদি প্রতিবছর সমন্বয় করা না হয়, তাহলে কম মজুরি আরও কমে যায়। তিনি বলেন, প্রতিবছর জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। সেটার সঙ্গে মজুরি কখনোই সমন্বয় করা হচ্ছে না। শ্রমিকদের ব্যাপারে শুধু দেখা হয়, তাঁর যতটুকু ছিল, তার চেয়ে কিছুটা বেড়েছে কি না। কিন্তু শ্রমিকের যে ভালো থাকা, ভালো খাওয়া, সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়া দরকার, তা কখনোই বিবেচনায় নেওয়া হয় না।
সুলতান উদ্দিন আহম্মদ মনে করেন, দেশে জাতীয় গড় আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি জাতীয় নিম্নতম মজুরির মানদণ্ড করা দরকার। সেটা প্রতিবছর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় হতে হবে। তিনি বলেন, দেশে এখন গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। পোশাক খাতে যদি বছরে ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধি পায়, তাহলে তো প্রকৃত মজুরি দেড় শতাংশ কমে যাচ্ছে।
২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ। কিন্তু প্রকৃত মজুরি বেড়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারে মজুরি না বাড়ায় শ্রমিকেরা অর্থনৈতিক উন্নতির ভাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এ পার্থক্য অতীতে আরও বেশি ছিল। সাম্প্রতিককালে তা কমে এসেছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। তবে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধিটা জিডিপির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
প্রকৃত মজুরি অন্যান্য দেশের চেয়ে কম হারে বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এ প্রতিবেদনটি দেখিনি। না দেখে মন্তব্য করতে চাই না।’
বৈষম্য ধনী দেশে
আইএলওর প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী কর্মীদের মধ্যে বৈষম্যের একটি চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানো হয়, ইউরোপে উচ্চস্তরে থাকা ১০ শতাংশ কর্মী মোট বেতন ব্যয়ের ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ পাচ্ছেন। অন্যদিকে নিচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশ কর্মী পাচ্ছেন মোট বেতন ব্যয়ের ৩০ শতাংশের কম। অর্থাৎ, একটি প্রতিষ্ঠানে যদি ১০০ জন কর্মী থাকেন এবং ওই প্রতিষ্ঠানে মোট বেতন বাবদ ব্যয় ১ কোটি টাকা হয়, তাহলে উচ্চ পর্যায়ের ১০ জন পাচ্ছেন সাড়ে ২৫ লাখ টাকা। নিচের ৫০ জন পাচ্ছেন ৩০ লাখ টাকার কম।
এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, উচ্চ বেতন দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতন বৈষম্যও বেশি। সেখানে উচ্চস্তরের ১ শতাংশ নিচু স্তরের ১ শতাংশের চেয়ে ১১৯ গুণ বেশি বেতন পান।