কানাডিয়ান পেনশন ফান্ডের ভারতে বিনিয়োগ
ভারত থেকে লক্ষ লক্ষ পড়ুয়া কানাডায় শিক্ষা লাভের জন্য যান। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের নথি অনুসারে, ভারতের দুই লক্ষ ৩০ হাজার শিক্ষার্থী ওই দেশে পড়াশোনা করছেন।
১৮ লক্ষ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ কানাডার নাগরিক এবং দশ লক্ষ ভারতীয় ওই দেশে বসবাস করেন।
প্রসঙ্গত, কানাডা সেই দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে যেখানে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় বাস করেন।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয়দের কাছে কানাডা একটা গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মাঝে উত্তেজনা বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়বে সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের ওপর।
অন্যদিকে এটাও উল্লেখযোগ্য যে ভারতীয় পড়ুয়ারা সে দেশে শিক্ষাগ্রহণের জন্য যাওয়ার ফলে কানাডা আর্থিকভাবে উপকৃত হয়।
বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে কানাডা যদি ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে দুই দেশের মধ্যে যে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে সেটা ধাক্কা খেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কানাডিয়ান পেনশন ফান্ডের কোটি কোটি ডলার ভারতে বিনিয়োগ করা হয়। কানাডিয়ান পেনশন প্ল্যান ইনভেস্টমেন্ট বোর্ড এবং সে দেশের অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখনও পর্যন্ত ভারতে মোট ৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
ভারত উদীয়মান অর্থনীতির দেশ এবং এমনটা আশা করা হয় যে কানাডিয়ান পেনশন ফান্ডের ওই বিনিয়োগ এখনই বন্ধ হবে না।
অন্যদিকে, ভারতে কানাডার ৬০০টিরও বেশি সংস্থার উপস্থিতি রয়েছে। ১০০০-এরও বেশি কানাডিয়ান সংস্থা সক্রিয়ভাবে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা করছে।
কানাডায় ভারতীয় সংস্থাগুলো তথ্যপ্রযুক্তি, সফ্টওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ইস্পাত, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ব্যাংকিং সেক্টরে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
ব্যবসায়িক সম্পর্কের নিরিখে কার পাল্লা ভারী?
ভারত প্রধানত কানাডায় রত্ন, গয়না, মূল্যবান পাথর, ওষুধ, তৈরি পোশাক, জৈব রাসায়নিক এবং হালকা প্রকৌশল পণ্য রফতানি করে থাকে।
আর কানাডা থেকে ডাল, নিউজপ্রিন্ট, কাঠের মণ্ড, অ্যাসবেস্টস, পটাশ, লোহার স্ক্র্যাপ, তামা, খনিজ এবং শিল্প রাসায়নিক আমদানি করা হয় ভারতে।
ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড ফ্যাসিলিটেশন এজেন্সি (ইনভেস্ট ইন্ডিয়া) অনুসারে, ভারতে বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে কানাডার স্থান রয়েছে ১৮ নম্বরে।
২০২০-২০২১ থেকে ২০২২-২০২৩ পর্যন্ত ভারতে কানাডার মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৩১ কোটি ডলার। যদিও কানাডার এই বিনিয়োগ ভারতের মোট এফডিআইয়ের মাত্র অর্ধ শতাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারত সরকারের এক সূত্র বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেছে, “কানাডার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়ে এই মুহূর্তে আমরা উদ্বিগ্ন নই। কানাডার সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য খুব একটা বড় নয়।”
“কানাডার পেনশন ফান্ডের যে অর্থ ভারতে বিনিয়োগ করা হয় তা রিটার্নের উপর ভিত্তি করে। ভারত ভালো রিটার্ন পাচ্ছে, তাই আমরা এটা নিয়েও চিন্তিত নই।”
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কানাডা ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮৪০ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় সামান্য বেশি।
কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী মেরি এনজি সোমবার বলেন, “আমি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্বস্ত করতে চাই যে আমাদের সরকার ভারতের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
প্রকৃত সমস্যা কি প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো?
অগাস্ট মাসে কানাডা ভারতে ২৭.৯০ কোটি ডলার অর্থমূল্যের রফতানি করেছিল এবং ভারত থেকে আমদানি করেছিল ৩২.৪ কোটি ডলারের। এই সংখ্যা কিন্তু গত বছরের অগাস্ট মাসের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি।
অজয় বিসারিয়া ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কানাডায় ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন। ইংরেজি পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমসকে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় না বাণিজ্য ও বিনিয়োগে এর কোনও প্রভাব পড়বে। ভারতের সমস্যা কিন্তু ট্রুডো, কানাডা নয়। দুই দেশই স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে বাণিজ্য, ভিসা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনও বাধা থাকা উচিৎ নয়।”
২০২২ সালের মার্চ মাসে দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যের বিষয়ে চুক্তি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। গত বছর পর্যন্ত এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে নয় দফা আলোচনা হলেও এখন সমস্ত আলাপ-আলোচনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
তবে বিষয়টা শুধুমাত্র ব্যবসা নিয়েই নয়। গণতন্ত্রে নির্বাচনে জেতার জন্য বেশি ভোটের প্রয়োজন হয় এবং ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভাবাবেগের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়।
২০২১ এর পরিসংখ্যান বলছে, কানাডার জনসংখ্যার ২.১% শিখ সম্প্রদায়ভুক্ত। ২০০১ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত, গত ২০ বছরে কানাডায় শিখ জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। । এর মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষা, ক্যারিয়ার, চাকরির মতো কারণে পাঞ্জাব থেকে কানাডায় পাড়ি দিয়েছেন।
কানাডায় বসবাসরত শিখ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি টরন্টো এবং ভ্যাঙ্কুভারে বাস করে। শিখ ভোটব্যাংককে মাথায় রেখে এই সমস্ত এলাকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের দাবি, প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো তার রাজনৈতিক এজেন্ডার কারণে কানাডায় খালিস্তান সমর্থকদের পক্ষে কথা বলছেন।
প্রসঙ্গত, জগমিত সিংয়ের দল নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থন নিয়েই চলছিল ট্রুডোর সরকার। সেপ্টেম্বর মাসে সেই সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেও সংসদে আস্থা প্রস্তাবে জয় লাভ করতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো।
২০২৫ সালের অক্টোবরে কানাডায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা এবং জাস্টিন ট্রুডো চান কানাডায় বসবাসকারী শিখ সম্প্রদায় তাকে সমর্থন করুক।