নিউজ ডেস্ক: ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডেতে রাজধানীর সব তারুণ্যের স্রোত এসে মিশেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আর সেদিনই ভালোবাসা দূরে থাক একটু ভালো আচরণ না পেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র।
তার নাম তরুণ হোসেন। বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তার ভাই একজন হকার। ভাইয়ের টাকা সম্বল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দামি বিভাগ ফাইন্যান্সে পড়তেন তরুণ।
কিন্তু কালো বর্ণের দরিদ্র পরিবারের সন্তান তরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চবর্ণের পরিবেশে মানাতে পারেননি। তার ছিল দুটি শার্ট। খেয়ে না খেয়ে কাটত দিন। সহপাঠী ও শিক্ষকদের অবজ্ঞা আর অপমানের যন্ত্রণায় একসময় ফেল করে বসেন কুষ্টিয়ার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র তরুণ। যার জের ধরে একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি।
১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসেও ক্লাস করেন তরুণ। দুপুর ১২টার পর ক্লাস থেকে বেরিয়ে স্যার এফ রহমান হলে যান তিনি। সেখানে তার নিবাস ১০৮ নম্বর গণরুমে মোবাইল ফোন ও ব্যাগ রাখেন।
এর পর তরুণ চলে যান হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ কলার আড়ৎ এলাকায়। সেখানে বিকাল সাড়ে ৩টায় একটি নির্মাণাধীন ছয়তলা মসজিদ ভবনের নিচ থেকে তরুণের লাশ উদ্ধার করা হয়।
তরুণের করুণ মৃত্যুকে ঘিরে তোলপাড় চলছে সামাজিকমাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনালোচিত রেসিজম (বর্ণবাদ) নিয়ে সরব হয়েছেন অনেকে। উচ্চবর্ণের সংস্কৃতি কীভাবে মানবসত্তাকে খুন করছে তা নিয়ে সোচ্চার হচ্ছেন সচেতনরা।
এফ রহমান হলে তরুণের পাশের কক্ষে থাকতেন হাসান আল বান্না। ফেসবুকে প্রকাশিত এক লেখায় তরুণের কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন হাসান। জানিয়েছেন যন্ত্রণাদায়ক বাস্তবতার প্রতি তীব্র ক্ষোভ। নিচে লেখাটি তুলে ধরা হল-
‘হলের ছোটভাই তরুণ আত্মহত্যা করার পর অনেকেই, বিশেষ করে হলের ছোটভাইয়েরা বলেছে কিছু লেখার জন্য। গত কয়েক দিনে অনেক কিছুই লিখে মুছে ফেলেছি। কারণ তরুণকে আমি চিনি। না চিনলে আবেগঘন কিছু লিখে ফেলতে পারতাম হয়তো।
আমি হলে ১০৯ নম্বর রুমে থাকতাম, পাশের ১০৮-এর গণরুমে তরুণ থাকত। গত বছরের ফেব্রুয়ারির দিকে নিচতলার বাথরুমে দেখি একটি ছেলে হাপাচ্ছে। ওই দিনই জিজ্ঞেস করলাম এই ছেলে তুমি অসুস্থ নাকি? ও খুব লাজুক ভঙ্গিতে বলল ভাই আমার হাঁপানির সমস্যা আছে। ফ্লোরে ঘুমানো নিষেধ। গণরুমে থেকে সমস্যা একটু বাড়ছে। ওইদিন বড় ভাইসুলভ কিছু সস্তা উপদেশ দিলাম।
এর কয়েক দিন পর দেখি ছেলেটা বিকালে হলের ছাদে একা একা হাঁটছে। ওই দিনই ওর সঙ্গে অনেক কথা হল। ও অ্যাডমিশন টেস্টে অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে। ওর ভাই ফেরিওয়ালা, ভাই ওর পড়ালেখার টাকা দেয়। ও একটা সাবজেক্টে ফেইল করেছে, সিজিপিএ নিয়ে অনেক টেনশনে আছে।
ওই দিন ওকে অনেক বয়ান দিলাম। বললাম ভাই তোমার জামা ময়লা হতে পারে, তোমার ভাষা অশুদ্ধ হতে পারে কিন্তু তুমি ড্যাম কেয়ার থাকবা। তোমার ক্লাসে হয়তো ‘হানি সিংয়ের’ অনেক চাচাতো ভাইবোন পড়তে পারে, কিন্তু তাদের মতো সু্যোগ পাইলে তুমি হয়তো অক্সফোর্ড হার্ভাডে থাকতা।
কিন্তু ও যেদিন আত্মহত্যা করেছে, সত্যি বলতে কি- নামও শোনা লাগে নাই, আমার মনে ওর নামই এসেছে। ফিন্যান্সে পড়ে, সুইসাইড করার মতো আর কেউ নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো সাবজেক্ট যেমন আইন, ইকোনোমিক্স, ফিন্যান্স থেকে অনেকেই ঝরে পড়ে। চোখের সামনে অনেককেই ঝরে পড়তে দেখেছি। অনেকেই হয়তো আত্মহত্যা করে নাই।
কিন্তু তরুণের কেইস আলাদা। একটা মানুষ যখন সব জায়গায় ব্রাত্য হয়ে যায়, তখন সুইসাইড করা ছাড়া আর কিইবা করতে পারে। তরুণ হলে ব্রাত্য হয়ে গেছিলো। থার্ড ইয়ারে পড়েও ওকে গণরুমে থাকতে হয়েছে। কারণ হলে একটা সিট ম্যানেজ করতে যে ম্যাকানিজম করা লাগে, তাতে সে ব্যর্থ হয়েছে।
তরুণ ডিপার্টমেন্টে ব্রাত্য হয়েছে। কারণ ঢাবির দামি সাবজেক্টগুলোতে হানি সিংয়ের চাচাতো ভাইবোনেরা পড়ে অথবা ভর্তি হওয়ার পর ইয়ো ইয়ো হানি সিংয়ের চাচাতো ভাইবোন হয়ে যায়। এসব ডিপার্টমেন্টের টিচাররাও হানি সিংয়ের বাপ-চাচা। এসব জায়গায় কুষ্টিয়া থেকে আসা ফেরিওয়ালার ভাই তরুণ খুবই ডিস্টার্ব, খুবই বেমানান। বিশেষ করে ঢাবির বিজনেস ফ্যাকাল্টির মতো আলো ঝলমলে, কর্পোরেট ইনভায়রনমেন্টে তরুণরা খুবই বেমানান।
আর তরুণদের মতো গরিব ফেরিওয়ালার ভাই যাদের একমাত্র সম্বল ভালো রেজাল্ট, তখন বারবার খারাপ রেজাল্ট তরুণ মেনে নিতে পারেনি। এর পর তরুণ নিজের পরিবারের কাছেও ব্রাত্য হয়ে গেছে। গরিবের ঘরের ছেলে ঢাবিতে পড়ে মানে কিছু দিন পরও সে বিসিএস ক্যাডার, ম্যাজিস্ট্রেট হবে। এ জন্য বাপ-ভাই ফেরি করে, গরু বেঁচে, গাছ বেঁচে টাকা পাঠায়, সেখানে তিন বছর টাকা পাঠানোর পরও তরুণ পরিবারের ইচ্ছা পূরণের কাছাকাছিও যেতে পারেনি। পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেয়া তার কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। নিজের হাঁপানি তরুণকে নিজের কাছে ব্রাত্য করেছে। পরিণতিতে তরুণ ছয়তলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। আরও তরুণরা আমাদের আশপাশে আছে। হয়তো এখনও ঝাঁপ দেওয়ার মতো ছাদ খুঁজে পায় নাই। তাদের বাঁচানোর একটিই উপায়- তাদেরকে ভালোবাসা।
হে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দামি সাবজেক্টে পড়ুয়া হানি সিংয়ের চাচাতো ভাইবোনেরা- তোমরা তোমাদের পাশের ব্রাত্য তরুণদের খোঁজ নাও। তাদেরকে ভালোবাসো। তাদেরকে বাঁচতে দাও। নিশ্চয়ই তোমাদের চেয়ে তাদের মধ্যে অনেক বেশি সম্ভাবনা আছে। আর তরুণ, এভাবে মরে গিয়ে আমাদের মরার আগে খুন হওয়ার ফিলিংস দিস না ভাই। তোর একমাত্র হলুদ গেঞ্জির কসম- এভাবে মরে যাস নে। তরুণের একটামাত্র টি-শার্ট ছিল- হলুদ রঙের। আরেকটি ছিল কালো স্ট্রাইপের।’