বাবরি মসজিদ ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত অযোধ্যার একটি ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থাপনা। মুঘল সম্রাট বাবরের আমলে ১৫২৮ সালে নির্মিত এই মসজিদ ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হাজার হাজার করসেবকের হাতে ৪৬২ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক মসজিদটি ভেঙে ফেলা হয়। এতে ভারতের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।
এর পর ৩২ বছর অতিবাহিত হলেও ঘটনাটি আজও ভারতের রাজনীতি ও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে রয়েছে।
বাবরি মসজিদের ইতিহাস
নির্মাণকাল ও স্থাপত্য : মসজিদটি ১৫২৮-২৯ সালে মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি নির্মাণ করেন। সম্রাট বাবরের নামে তা বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত। পরবর্তীতে তা ওই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
এই কাঠামোতে শব্দের অনন্য স্থাপনা দর্শনার্থীকে বিস্মিত করবে।’
আধুনিক স্থপতিদের মতে, বাবরি মসজিদের চিত্তাকর্ষক স্বনবিদ্যার কারণ হলো, মসজিদটির মিহরাব (মসজিদের একদিকে একটি অর্ধবৃত্তাকার দেয়াল যা কিবলা নির্দেশ করে) ও পার্শ্ববর্তী দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন খাঁজ রয়েছে যা অনুনাদক হিসাবে কাজ করত। এই নকশা মিহরাবে অবস্থিত ইমামের কথা সবাইকে শুনতে সাহায্য করত। এছাড়াও বাবরি মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বেলেপাথর অনুনাদের কাজ করে যা মসজিদটির শব্দ-নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় সাহায্য করত।
বিতর্কের সূত্রপাত যেভাবে
১৮৫৩ সালে প্রথমবারের মতো মন্দির-মসজিদ বিতর্কের সূত্রপাত হয়। তখন হিন্দু সম্প্রদায় দাবি করে, তা ছিল রামের জন্মস্থান। ব্রিটিশ শাসনকালে মসজিদটির চত্বরে হিন্দুদের পূজা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়। ১৯৪৯ সালে হিন্দু সক্রিয়তাবাদীরা হিন্দু মহাসভার সঙ্গে জোট করে গোপনে রামের একটি মূর্তি মসজিদের অভ্যন্তরে রেখে দেয়। এরপরই সরকার দাঙ্গা ঠেকানোর অভিপ্রায়ে পুরো মসজিদকে সিলগালা করে দেয়। পরে হিন্দু-মুসলিম উভয়ই ওই স্থানে প্রবেশাধিকার পেতে আদালতে মামলা করে।
১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো যেমন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও বিজেপি ইত্যাদি বাবরি মসজিদের জায়গায় রামের মন্দির পুনঃনির্মাণের দাবি জোরদার করে। ১৯৯০ সালে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানী রথযাত্রার মাধ্যমে ব্যাপক সমর্থন অর্জন করে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর লাখো করসেবক বাবরি মসজিদের চত্বরে জড়ো হয়। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মধ্যে তারা মসজিদের গম্বুজ ভেঙে ফেলে। প্রশাসনের ব্যর্থতা ও নিরাপত্তার অভাবে মসজিদটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়। ঘটনার পর পুরো ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এর অধিকাংশই ছিল মুসলিম। মুসলিম সম্প্রদায় এই ঘটনাকে তাদের ধর্মীয় অধিকার ও অস্তিত্বের ওপর আঘাত হিসেবে দেখে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ভারতের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নিয়ে সমালোচনা হয়। (গোপাল সারভাপেলি, দ্যা বাবরি মসজিদ ইস্যু এন্ড দ্যা হিন্দুত্বভা এজেন্ডা, পেঙ্গুইন বুকস)
বাবরি মসজিদ নিয়ে আইনি লড়াই
আইনি প্রক্রিয়া : মসজিদের ধ্বংসের পর একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ছিল জমির মালিকানা নিয়ে বিতর্ক। এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২০১০ সালে রায় দেয়, বিতর্কিত জমি তিনভাগে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখাড়া, রামলালার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হোক। এর ফলে হিন্দুরা পায় জমির তিন ভাগের দুই ভাগ। মুসলিমরা এক ভাগ। এর বিরুদ্ধে সব পক্ষই উচ্চ আদালতে আপিল করে।
বাবরি মসজিদ ভাঙার পরবর্তী প্রভাব
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। তা শুধুমাত্র ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক নয়, বরং বিশ্বমঞ্চে ভারতের পরিচিতিতেও গভীর ছাপ ফেলে। এই ঘটনার বিভিন্ন প্রভাব নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উত্তেজনা
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ভারতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনা মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে গভীর আঘাত হানে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তীব্রতর হয়। ঘটনার পরপরই মুম্বাই, দিল্লি, আহমেদাবাদ, কানপুরসহ বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গায় প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত হয়, যার বেশিরভাগ ছিল মুসলিম।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। কারণ এ ঘটনার পরই বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করে। ১৯৯৮ সালে বিজেপি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসে এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রসার ঘটে। তা ছাড়া এই ঘটনা ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণকে ত্বরান্বিত করে। ফলে হিন্দুত্ববাদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়।
৩. বিচারব্যবস্থা ও আইন প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর আদালত এবং প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে (২০১০) বিতর্কিত জমি তিন ভাগে বিভক্ত করতে বলা হয়। আর সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ে (২০১৯) হিন্দুদের পক্ষে যায় এবং বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয় এবং মুসলিমদের জন্য বিকল্প জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। মুসলিম সম্প্রদায় আদালতের রায়কে তাদের অধিকারের প্রতি বৈষম্যমূলক হিসেবে দেখে। এতে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
৪. আন্তর্জাতিক প্রভাব ও সমালোচনা
বাবরি মসজিদ ধ্বংস আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে। ফলে সৌদি আরব, পাকিস্তান, ইরানসহ মুসলিম দেশগুলো এই ঘটনার এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি দেশটির আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
৫. ধর্মীয় সম্প্রীতির অবনতি
মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ভারতের ধর্মীয় সম্প্রীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তা ভারতের ধর্মীয় বহুত্ববাদী চরিত্রের ওপর চপেটাঘাত করে। তা ছাড়া হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটে। তা ছাড় মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে। (মুজাফফর আলম, দ্যা মুসলিম মাইনোরিটি অ্যান্ড দ্যা ইন্ডিয়ান স্টেট)
৬. অর্থনৈতিক প্রভাব
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উত্তেজনার কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দেয়। বিশেষত শহুরে এলাকায় এর বিরূপ প্রভাব দেখা যায়। একাধিকবার মুসলমানদের দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়েও ধূলিস্যাৎ করা হয়। এতে ভারতের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার প্রতি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ কমে যায়।
৭. শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভাব
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা শিক্ষাক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ধর্মীয় উত্তেজনার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেরুকরণ দেখা দেয়। এমনকি মুসলিম নারী শিক্ষার্থীদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাও ঘটে। তা ছাড়া ভারতীয় সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতায় প্রভাব পড়ে। এতে ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি সংবেদনশীলতা কমে যায়। বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয় যা এখনো চলমান। (জেফারলট, দ্যা হিন্দু ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট অ্যান্ড ইন্ডিয়ান পলিটিক্স)
৩২ বছর পরে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি গভীর স্মৃতি ও বেদনার প্রতীক। তা ভারতীয় মুসলিমদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছে। বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা শুধুমাত্র একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের বিলুপ্তি নয়, বরং তা ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ৩২ বছর পরও এই ঘটনার প্রভাব পুরো দেশজুড়ে বিদ্যমান। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই ক্ষত নিরাময় সম্ভব। তা শুধু ভারত নয়, পুরো বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।