ই-কমার্সের এই যুগে একটি ক্লিকের বদৌলতে ঘরে বসেই এখন সব কিছু পাওয়া যায়। গৃহস্থালি ও খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে লাখ টাকার প্রযুক্তি পণ্য কোনোটাই বাদ নেই এই তালিকায়। পশ্চিমা দেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে বৈধভাবে অনলাইনে মদ ও বিয়ার বিক্রি হয়। বাংলাদেশে এ ধরণের বিক্রি অবৈধ হলেও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে মদ-বিয়ার বিক্রির খবর পাওয়া গেছে।
অনলাইন ঘেঁটে এ ধরণের কয়েকটি পেজের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব পেজে বিদেশি মদের বোতলের ছবি, দাম বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া রয়েছে। কেবল একটি পেজ ছাড়া অন্যগুলোতে যোগাযোগের জন্য ইনবক্সে বার্তা পাঠাতে বলা হয়েছে। বার্তা পাঠানোর পর ক্রেতাকে এরা ফোন নম্বর দেয়। এসব পেজের অ্যাডমিনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে ফোনে অর্ডার করা হলে ক্রেতার নির্ধারিত স্থানে মদ বা বিয়ার পৌঁছে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ক্রেতার মদ পানের লাইসেন্স কোনো সমস্যাই না। এমনকি একজন বিক্রেতা জানিয়েছেন, তাদের কাছে মদ বিক্রিরও কোনো লাইসেন্স নেই।
ফেসবুক পেজের মাধ্যমে মদ বিক্রির জন্য যে কটি পেজ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা রয়েছে অনলাইন বার বিডিকে (fb.com/onlinebarbd) নিয়ে। এই পেজটিতে বিদেশি মদের তালিকা নিয়মিত আপডেট হয়। এতে যোগাযোগের জন্য সরাসরি ফোন নম্বরই দেওয়া আছে। পেজটিতে দাবি করা হয়েছে, দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ফোন করলে মদ বা বিয়ার সেই স্থানে পৌঁছে দেওয়া হবে। মূল্য পরিশোধের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, কেবল হাতে পাওয়ার পরই ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করবেন। সোমবার থেকে রোববার সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্রাহক অর্ডার করতে পারবেন বলেও এতে বলা হয়েছে। পেজটিতে গুগল ম্যাপ অ্যাড করে এতে সরবরাহকারীর অবস্থান রাজধানীর বংশালের কাছে ঢাকেশ্বরী রোড দেখানো হয়েছে।
অনলাইন বার বিডির ফেসবুক পেজে দেওয়া ফোন নম্বরে সম্প্রতি বেশ কয়েকবার কল করা হলে কেউ ফোন ধরেননি। তবে অনেক সময় পরে ওই নম্বর থেকে ফিরতি কল করা হয়। ক্রেতা সেজে এক বোতল হুইস্কি কিনতে ইচ্ছুক জানানোর পর অপরপ্রান্ত থেকে ব্র্যান্ডের নাম জানতে চাওয়া হয়। নাম বলার পর অপরপ্রান্তের ব্যক্তি জানান, এর দাম পড়বে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। অর্ধেক মূল্য অগ্রিম হিসেবে বিকাশ নম্বরে পাঠাতে হবে। মূল্য পাওয়ার পর ক্রেতার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী অনলাইন বার বিডির সরবরাহকারী ওই ব্র্যান্ডের হুইস্কি পৌঁছে দেবেন।
অগ্রিম মূল্য দিলে প্রতারণার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘স্যার আমরা তিন বছর ধরে এ ব্যবসা করে আসছি। আমাদের সঙ্গে আপনি একবার ডিল করে দেখুন ই না।’
সরবরাহকারীর কাছে লাইসেন্স আছে কিনা জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেক সরবরাহকারীর কাছেই লাইসেন্স আছে। এ কারণে পুলিশ ধরলেও কোনো সমস্যা হবে না।’
বিকাশ নম্বরটি চাইলে ওই ব্যক্তি জানান, একটু পরেই নম্বরটি এসমএস করে দেওয়া হবে। এরপরই তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের ফোন নম্বরে অনলাইন বার বিডির নম্বর থেকে একটি ক্ষুদে বার্তা আসে। এতে বিকাশ নম্বর দেওয়া হয়। ক্ষুদে বার্তাটি এসেছে কিনা জানতে একটু পর ফোন দেন ওই ব্যক্তি।
ফেসবুক পেজে মদ বিক্রির জন্য ব্যবহারকারীদের আলোচনায় থাকা দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় পেজটি হচ্ছে ড্রিংক বার বিডি Drinkbarbd (https://m.facebook.com/Drinkbarbd/?hc_location=ufi)। এই পেজের ফলোয়ার ১৩ হাজার ৬৯৭। পেজে এর অবস্থান বলা হয়েছে রাজধানীর গুলশান এলাকা। এরা অবশ্য যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বর দেয়নি। আগ্রহীদের ইনবক্সে বার্তা দিতে বলা হয়েছে।
এখানেও ক্রেতা সেজে ইনবক্সে বার্তা দেয়া হলে যোগাযোগের জন্য একটি ফোন নাম্বার দেওয়া হয়। এতে ফোন করা হলে অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটি জানান, তাদের হোম ডেলিভারি সার্ভিস এখন বন্ধ আছে। জানুয়ারি থেকে এটি পুনরায় চালু হবে। তবে কারো প্রয়োজন হলে বনানী এসে ফোন দিলে হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে। হোম ডেলিভারি সার্ভিসের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রিম টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের এ ধরণের নিয়ম-কানুন নেই। হাতে পাওয়ার পর টাকা দেবেন।’
লাইসেন্স আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের এগুলা লাগে না।’
পুলিশ ধরলে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ওগুলা ম্যানেজ করতে পারি।’
ড্রিংক বার বিডির মতোই একই ধাঁচের পেজ হচ্ছে Booze BD (https://www.facebook.com/Booze-BD-1631722723795049/?skip_nax_wizard=true&hc_location=ufi) এবং Irfan`s Bar BD (https://www.facebook.com/irfanbd88/?hc_ref=PAGES_TIMELINE&fref=nf)। এ দুটি পেজেও যোগাযোগের জন্য ইনবক্সে বার্তা পাঠাতে বলা হয়েছে। তবে পেজ দুটির ইনবক্সে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ফেসবুকে সেল বাই একচেঞ্জ বিডি (sell buy xchange bd) নামের অপর একটি পেজে সম্প্রতি ভদকা ও হুইস্কি শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এটি পোস্ট করা হয়েছে স্যাম হান্ট নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে। বিজ্ঞাপনটিতে কয়েকটি বিদেশি মদের বোতলের ছবি দেওয়া থাকলেও যোগাযোগের জন্য কোনো ফোন নম্বর দেওয়া হয়নি। চাহিদা অনুযায়ী মদের বোতল পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইনবক্সে বার্তা দিতে বলা হয়েছে। তবে গত বৃহস্পতিবার সেল বাই একচেঞ্জ বিডি’র পেজে আর বিজ্ঞাপনটি দেখা যায়নি।
১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১০ (২) ধারা অনুযায়ী, পারমিট ব্যতীত কোন ব্যক্তি অ্যালকোহল বা মদ পান করতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, আইনে মদ বিক্রি ও বিক্রেতার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সে হিসেবে অনলাইনে এভাবে মদ বিক্রির প্রক্রিয়া বৈধ নয়।
ফেসবুক পেজ ব্যবহার করে এভাবে মদ বিক্রির বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিষয়টি আমিও শুনেছি। কিন্তু যারা এ ব্যবসা করছে তাদের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য ১৪ জন ইন্সপেক্টরেকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যবসাকে ‘ড্রাগ নেট বিজনেস’ বলে। অবশ্য আমাদের দেশে এ রকম ব্যবসা করার কোনো নিয়ম নেই। এ জন্য কাউকে লাইন্সেসও দেওয়া হয় না। একই সঙ্গে এ রকম সুনির্দিষ্ট তথ্য-পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান (ডিসি) বলেন, ‘এ বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, ‘আইন অনুযায়ী কেবল তিন শ্রেণির লোকের কাছে মদ বিক্রি করা বৈধ। বিদেশি নাগরিক ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারী ব্যক্তি, লাইসেন্স বা পারমিট পাওয়া ব্যক্তি এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে চিকিৎসকের লিখিত ব্যবস্থাপত্রের ভিত্তিতে পাওয়া পারমিটধারী ব্যক্তি ছাড়া কারো কাছে মদ বিক্রি সম্পূর্ণ অবৈধ। এভাবে অনলাইনে প্রকাশ্যে মদ বিক্রি যেমন মাদক আইন ও শুল্ক আইনের লঙ্ঘন, তেমনি সম্পূর্ণরুপে নৈতিকতার পরিপন্থী। এ ধরণের লোকদের খোঁজ পাওয়া গেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
নিউজ : রাইজিংবিডি খেকে সংগ্রহ !