ফিলিস্তিন নবী-রাসুলদের স্মৃতিধন্য এক বরকতময় ভূমি। মিরাজের রাতে মহানবী (সা.) এই বরকতময় ভূমিতে অবতরণ করেন এবং তাঁর পেছনে সব নবী-রাসুল নামাজ আদায় করেন। পবিত্র কোরআনে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি নিজ বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং আমি তাঁকে ও লুতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই দেশে যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি বিশ্ববাসীর জন্য।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৭১)
ফলে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরে ফিলিস্তিন ভূমির ভালোবাসা প্রোথিত। তারা পবিত্র এই ভূমির মুক্তি কামনা করে এবং তারা চায় এখানে সব ধরনের হানাহানি বন্ধ হোক এবং ইবরাহিম (আ.)-এর প্রকৃত উত্তরসূরীরা নিরাপদে জীবনযাপন করুক। ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনি মুসলমানদের মুক্তি প্রত্যাশী মানুষদের জন্য রয়েছে মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। যা থেকে প্রমাণিত হয় পবিত্র এই ভূমি অবশ্যই ভিনদেশী অভিশপ্তদের দখলদারিত্ব ও অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভ করবে।
ফিলিস্তিনের আলোকিত ভবিষ্যত
মহানবী (সা.) পবিত্র এই ভূমির ব্যাপারে যেসব সুসংবাদ দিয়ে গেছেন তা নিম্নে তুলে ধরা হলো।
১. নববী শাসনের সূচনা : কিয়ামতের আগে পৃথিবীতে আবারো ইসলামী খেলাফত বা নববী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। আর সেই শাসনের সূচনা হবে ফিলিস্তিন থেকে। আবদুল্লাহ ইবনু হাওয়ালা আল আজদি (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার মাথা বা মাথার তালুতে হাত রেখে বললেন, হে ইবনু হাওয়ালা! যখন তুমি দেখবে যে, বায়তুল মাকদিসে (বা শাম দেশে) খিলাফাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন মনে করবে অধিক ভূমিকম্প, বিপদ-আপদ, মহাদুর্ঘটনা ও পেরেশানি সন্নিকটে। কিয়ামত তখন মানুষের এতই নিকটবর্তী হবে, যেমন আমার এ হাত তোমার মাথার যত নিকটে আছে।’ (সুনানু আবি দাউদ, হাদিস : ২৫৩৫)
২. বিজয় আসন্ন : কিয়ামতের আগে ফিলিস্তিন ভূমি থেকে অবশ্যই অবৈধ দখলদারিত্বের অবসান এবং মুসলানের বিজয় আসবে। যদিও সে বিজয় হবে কিয়ামতের নিদর্শনস্বরূপ। মুয়াজ ইবনু জাবাল (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বায়তুল মাকদিসে বসতি স্থাপন ইয়াসরিবের বিপর্যয়ের কারণ হবে। আর ইয়াসরিবের বিপর্যয় সংঘাতের কারণ হবে। যুদ্ধের ফলে কুসতুনতিনিয়া বিজয় হবে এবং কুসতুনতিনিয়ার বিজয় দাজ্জালের আবির্ভাবের আলামত।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪২৯৪)
৩. মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের আসন : হাদিসের বর্ণনা ও ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যা অনুসারে ঈসা (আ.) দাজ্জাল ও তার অনুসারী ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। তাদের যুদ্ধ হবে ফিলিস্তিন ভূমিতে। ঈসা (আ.) ফিলিস্তিনের লুদ শহরে দাজ্জালকে হত্যা করবেন। অতঃপর যুদ্ধে ইহুদিদের পরাজিত করবেন। তারা পালিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারবে না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯২২; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১/১২৮)
উপরের উদ্ধৃতি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় কিয়ামতের আগে ফিলিস্তিন ভূমি থেকেই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া হবে।
৫. দাজ্জালের আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা : দাজ্জালের জগতব্যাপী ফেতনা থেকে মহান আল্লাহ দুটি শহর ও চারটি মসজিদকে রক্ষা করবেন। শহর দুটি হলো মক্কা ও মদিনা এবং মসজিদ চারটি হলো মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী, মসজিদে তুর ও মসজিদে আকসা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মক্কা ও মদিনা ছাড়া এমন কোনো শহর নেই যেখানে দাজ্জাল পদচারণ করবে না। মক্কা এবং মদিনার প্রত্যেকটি প্রবেশ পথেই ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে পাহারায় নিয়োজিত থাকবে। এরপর মদিনা তার অধিবাসীদের নিয়ে তিনবার কেঁপে উঠবে এবং আল্লাহ তাআলা সমস্ত কাফির এবং মুনাফিকদের বের করে দেবেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮১)
অন্যদিকে দাজ্জাল ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে পারলেও মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করতে পারবে না। নবীজি (সা.) বলেন, দাজ্জাল চারটি মসজিদের নিকটে যেতে পারবে না। তা হলো, মসজিদুল হারাম, মসজিদে মদিনা (নববী), মসজিদে তুর ও মসজিদে আকসা। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৩৬৮৫)
৬. ইমাম মাহদি (আ.)-এর অবস্থান : ইমাম মাহদি (আ.) শেষ মুহূর্তে মুসলিমদের নিয়ে মসজিদুল আকসায় আশ্রয় নেবেন। বাহিরে দাজ্জাল ইহুদিদের নিয়ে তাদের হত্যা করার জন্য বন্দি করে রাখবে। অন্যদিকে মুসলিমরাও দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে। এরই মধ্যে ঈসা (আ.) দামেস্কে আগমন করবেন এবং তিনি মুমিনদের রক্ষা করতে ফিলিস্তিনের রওনা হবেন। তিনি মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে মুসলমানদের নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যার জন্য বের হবেন। দাজ্জাল পশ্চিম দিকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ফিলিস্তিনের লুদ নামক স্থানে তিনি তাকে হত্যা করবেন। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২২৪০; ইসলাম হিস্টোরি ডটকম)
৭. মুসলমানদের নিরাপদ ভূমি : দাজ্জাল সম্পর্কিত সুনানে তিরমিজির দীর্ঘ বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায় ফিলিস্তিন হবে ঈসা (আ.)-এর বিচরণ ভূমি। এমনকি দাজ্জাল হত্যার পর ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব হলে তারা ফিলিস্তিনের ‘আল খামার’ পাহাড়ে এসে তাদের আগ্রাসন শেষ করবে। ঈসা (আ.) তখন মুমিনদের নিয়ে তুর পাহাড়ে চলে যাবেন। (বর্তমান ইসরাইলের একটি পাহাড়ের নাম তুর। তবে বিখ্যাত তুর পাহাড় মিসরে অবস্থিত)। এর দ্বারা বোঝা যায়, ইয়াজুজ-মাজুজ বাহিনীকে আল্লাহ ফিলিস্তিনে ধ্বংস করবেন এবং ফিলিস্তিন ভূমিকে অন্য ভূমির তুলনায় বেশি সময় নিরাপদ থাকবে। (বিস্তারিত দেখুন : সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২২৪০)
৮. সত্যের পক্ষে বিজয়ীদের ভূমি : বায়তুল মুকাদ্দাস তথা ফিলিস্তিনকে মহানবী (সা.) বিজয়ীদের ভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার উম্মতের একটি দল সত্যের ওপর বিজয়ী থাকবে। শত্রুর মনে পরাক্রমশালী থাকবে। দুর্ভিক্ষ ছাড়া কোনো বিরোধী পক্ষ তাদের কিছুই করতে পারবে না। আল্লাহর আদেশ তথা কিয়ামত পর্যন্ত তারা এমনই থাকবে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তারা কোথায় থাকবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তারা বায়তুল মুকাদ্দাস এবং তার আশপাশে থাকবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৩২০)
আল্লাহ নিযাতিত ফিলিস্তিনি মুসলমানের মুক্তি তরান্বিত করুন। আমিন।