নিউজ ডেস্ক:
রাশিয়ার সব চেয়ে বড় মিউজিয়াম ‘হের্মিতাজ উইন্টার প্যালেস’ ঠিকমতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগে না কি এক মাস। ইউরোপের অন্যতম সুন্দর শহরের এই মিউজিয়াম অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী বুকে করে দাঁড়িয়ে আছে।
এক মাস নয়, ফ্রান্স কোচ দিদিয়ে দেঁশ এবং বেলজিয়াম কোচ রবের্তো মার্তিনেসের সামনে ইতিহাস তৈরির সময় কিন্তু মাত্র নব্বই বা একশো কুড়ি মিনিট। বড় জোর টাইব্রেকার।
আজ, মঙ্গলবার জেনিনা এরিনায় ফ্রান্স বনাম বেলজিয়াম ম্যাচে যে কোচের কপালেই জয় তিলক আঁকা হোক, তিনি ইতিহাসে চলে যেতে পারেন। অথবা ইতিহাসর সামনে এসে দাঁড়াতে পারেন।
বেলজিয়াম জিতলে বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে প্রথমবার ফাইনালে উঠবেন রোমেলু লোকাকুরা। আর ফ্রান্স জিতলে দেশঁর সামনে খুলে যাবে ইতিহাস ছোঁয়ার সুবর্ণ সুযোগ। ফাইনালে দলকে জেতাতে পারলে ফ্রানৎস বেকেনবাউয়ার এবং মারিয়ো জাগালোর সঙ্গে একই সিংহাসনে বসতে পারবেন তিনি। ফুটবলার ও কোচ হিসাবে দেশকে চ্যাম্পিয়ন করার জন্য।
কিন্তু সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে যে দু’দলের কোচই লুকোচুরি খেললেন সোমবার।
অলিভিয়ে জিহুরা যখন স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতে নামছেন, তখন মস্কোয় অনুশীলন শেষ করে সেন্ট পিটার্সবার্গ হোটেলে ঢুকছেন রোমেলু লুকাকুরা। তাঁরা এখানে অনুশীলনই করলেন না ।
ইউরোপীয় ফুটবলের দুই শক্তিধর দেশের ধুন্ধুমার ম্যাচ। ফ্রান্সের দেঁশ এবং বেলজিয়ামের মার্তিনেস— দু’জনেই আক্রমনাত্মক ফুটবল পছন্দ করেন। একে অন্যের মগজাস্ত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তা সত্ত্বেও সুযোগ পেয়েও মূল স্টেডিয়ামে অনুশীলনই করল না বেলজিয়াম। সকালে মস্কোয় অনুশীলন করে পা রাখল নেভা নদীর পাশের এক হোটেলে। সম্ভবত নিজের রণনীতি প্রকাশ্যে না আনতেই এই কৌশল। কিন্তু তাতে কী? ‘‘আমি মার্তিনেসকে চিনি। ও আমার সঙ্গে ট্যাকটিক্যাল গেম খেলতে চাইবে। সেই সুযোগ আমরা দেব না। ব্রাজিল যে ভুলটা করেছে, আমার ছেলেরা করবে না। আমরা সব রকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি,’’ বলে দিয়েছেন জ়িনেদিন জ়িদানের সঙ্গে ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ করার অন্যতম কারিগর।
বিশাল নোভা নদীর উপর দিয়ে পাঁচটা ব্রিজ এঁকে বেঁকে চলে গিয়েছে নানা প্রান্তে। গভীর রাতে সেই ব্রিজগুলো দু’ঘন্টার জন্য সরে যায়। সেখান থেকে জাহাজ চলাচলের জন্য। বেলজিয়ামের মাঝমাঠের সঙ্গে স্ট্রাইকারদের ‘ব্রিজ’ ভাঙার জন্য দেঁশ কী যন্ত্র ব্যবহার করবেন, জানাননি। তবে এ দিন দেখলাম, অনুশীলনে নামতে দিলেন না কিলিয়ান এমবাপে-সহ চার ফুটবলারকে।
বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে আসলে অনেক রংয়ের কোলাজ। নতুনের আবাহনে হাজির অনেক চরিত্র। মিউজিয়ামের চেয়ে তা কম দর্শনীয় হবে না ফুটবলপ্রেমীদের কাছে।
কী কী দেখা যেতে পারে?
দেখা যাবে স্যামুয়েল উমতিতি বনাম লুকাকুর শক্তির লড়াই। বিশাল শরীরের লুকাকুকে রুখতে উমতিতিই আসল ওষুধ ফ্রান্সের। বার্সেলোনা স্টপারের অবশ্য সামান্য চোট আছে। তবে খেলবেন। এমবাপের সঙ্গে এডেন অ্যাজারের গতির যুদ্ধও তো দেখবে ফুটবল দুনিয়া দু’জনের দৌড় কতটা বিপদে ফেলে প্রতিপক্ষ রক্ষণকে তা দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে।
আঁতোয়া গ্রিজম্যান এবং কেভিন দ্য ব্রুইনকে নিয়ে দু’ই দেশের কোচের ফলস নাইন খেলানোর ভাবনা আদৌ সফল হয় কি না, সেটাও দেখার অপেক্ষায় থাকবেন সবাই। দু’দলের দুই গোলকিপার হুগো লরিস এবং থিবো কুর্তোয়া রয়েছেন দুরন্ত ফর্মে। তাঁদের মধ্যে কে অতিমানব হয়ে উঠবেন, কে আছড়ে পড়বেন, তা দেখতে চায় তো সবাই।
আরও আছে। একই ক্লাবে খেলেন অথচ মঙ্গলবার শত্রু হবেন এ রকম ফুটবলার অনেক। যেমন বেলজিয়ামের আ্যাজার এবং কুর্তোয়া খেলবেন তাঁদের সঙ্গে চেলসিতে খেলা ফ্রান্সের এনগোলো কঁতে এবং অলিভিয়ে জিহুর বিরুদ্ধে। আবার ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের পল পোগবা খেলবেন তাঁর ক্লাব সতীর্থ মারুয়ান ফেলাইনি ও লুকাকুর বিরুদ্ধে।
ফ্রান্স কোচ দেশঁ এক বার বলেছিলেন, ‘‘যে কোচের হাতে এক জন ভাল স্ট্রাইকার আর এক জন ভাল গোলকিপার থাকবে, সে অনেকটাই এগিয়ে থাকবে।’’ তাঁর হাতে তো এই ম্যাচে দু’টোই রয়েছে!
উল্টো দিকে বেলজিয়াম কোচ মার্তিনেসের দর্শন হল, ‘‘যে কোচের হাতে মাঝমাঠ থেকে বল দেওয়ার বেশি লোক থাকবে, সে-ই এগিয়ে থাকবে।’’ তাঁর হাতেও তো সেটা আছে! দে ব্রুইনের মতো মাঝমাঠে ফুল ফোটানোর পাসার। এ দিন যে দে ব্রুইন এসে বলে গেলেন, ‘‘আমরা স্বপ্নের ম্যাচ খেলতে নামছি। অন্য কিছু ভাবছি না। সবাই স্বপ্ন দেখছে জেতার। ইতিহাস ছোঁয়ার।’’
দুই কোচের ভাবনাতেই স্পষ্ট, আক্রমনই হাতিয়ার করতে চাইছেন তাঁরা। কিন্তু দু’দলের রক্ষণ কি সেই ঝড় সামলাতে পারবে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেন্ট পিটার্সবার্গ দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ ছিল হিটলার বাহিনীর হাতে। সোভিয়েত রাশিয়ার লালফৌজ হাল ছাড়েনি। লড়ে গিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত জিতেও গিয়েছিল। সেই ইতিহাস যেন উঁকি মারছে এই ম্যাচে। ফ্রান্স বা বেলজিয়াম রক্ষণ ‘লাল ফৌজ’ হতে না পারলে কিন্তু বিপদে পড়বে। কারণ দু’দলের আক্রমণই ভয়ঙ্কর শক্তিশালী। ফ্রান্সে এমবাপের সঙ্গে পোগবা, জিহুরা যেমন রয়েছেন, তেমনই লুকাকুর সঙ্গী হয়ে অ্যাজার, দে ব্রুইনরা আক্রমণের ঝড় তোলার জন্য অস্ত্রে শান দিচ্ছেন। তবে অ্যাজারদের দলের পক্ষে খারাপ খবরও আছে। তাদের উইং মসৃণ ভাবে চালানোর অন্যতম অস্ত্র, রাইট ব্যাক থোমাস মুনিয়ের এই ম্যাচে খেলতে পারছেন না। উল্টো দিকে ব্লেজ মাতুইদি ফিরছেন দেশঁর দলে।
পোগবাদের কোচ তা সত্ত্বেও এ দিন সাংবাদিক বৈঠকে একবারের জন্যও হাসেননি। রশিয়াকে কেমন লাগল, জানতে চেয়েছিলেন স্থানীয় এক সাংবাদিক। দেশঁ বলে দেন, ‘‘কাল কি রাশিয়ার খেলা আছে?’’ আরও বলেছেন, ‘‘বেলজিয়াম অত্যন্ত শক্তিশালী দল। ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ওঁরা যে রণনীতি নিয়েছিল, সে রকমই কিছু করার চেষ্টা করবে। সেটাই স্বাভাবিক। আমরাও তৈরি। পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরাও বদলাব।’’ তার প্রায় দু’ঘণ্টা পরে সাংবাদিকদের সামনে এসে মার্তিনেস হাসতে হাসতে বলে দিলেন, ‘‘ফ্রান্সের একটা ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। ওরা বিশ্বকাপ জিতেছে। বেলজিয়াম পারেনি। সেটাই আমাদের প্রেরণা।’’
প্যারিসের পরে ইউরোপের সব চেয়ে সাজানো শহর বলা হয় সেন্ট পিটার্সবার্গকে। অবরুদ্ধ থাকার সময় দু’টো জিনিস নিয়ে না কি মেতে থাকতেন রাশিয়ানরা। ব্যালে এবং ফুটবল বাঁচিয়ে রেখেছিল এই অঞ্চলের মানুষকে। দিয়েছিল বেঁচে থাকার আনন্দ। আজ, মঙ্গলবার বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনাল কতটা আনন্দ দেয়, তার দিকে তাঁকিয়ে ফুটবল বিশ্ব।