দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজের বিনিময়ে (পারিশ্রমিক/বেতনভাতাদি ছাড়া) যে অর্থ গ্রহণ করা হয়, তা-ই ঘুষ। এটা বকশিশ, হাদিয়া ইত্যাদি যে নামেই হোক।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়কে অভিসম্পাত দিয়েছেন। ’ (আবু দাউদ)
দাপ্তরিক কাজ যথাসময়ে করিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে অথবা কারো কাছে সুপারিশ করার বিনিময়ে কোনো নগদ দ্রব্য গ্রহণ করাও ঘুষের পর্যায়ে পড়ে। কোনো কর্মকর্তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিসে, কল-কারখানায় পরিদর্শনে গেলে পরিদর্শনকারী কর্মকর্তাকে আপ্যায়নসহ বিভিন্ন দ্রব্য, এমনকি নগদ অর্থ প্রদানের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করা হয়। এই নগদ অর্থ গ্রহণ করাকেই সমাজে ঘুষ হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু নগদ অর্থ ছাড়া দ্রব্যাদি গ্রহণ করা, আপ্যায়ন গ্রহণ করাকে ঘুষ বলে গণ্য করা হয় না, বরং সেটিকে হাদিয়া বা তোহফা হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু এগুলোও ঘুষের পর্যায়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) লিখেছেন, ‘হাদিয়া ও রেশওয়াত বা ঘুষ দেখতে প্রায় এক রকম দেখায়। সাধারণত যারা ঘুষ দেয়, তারা ওটাকে তোহফা, নজরানা, ডালি বা ভালোবাসার নিদর্শন বলে প্রকাশ করতে চায়। তারা এ রকম বলে, পান খেতে দিলাম, ছেলেকে-মাকে মিঠাই বা নাশতা খাওয়ার জন্য দিলাম ইত্যাদি। তাই হাদিয়া ও রেশওয়াত বা ঘুষের পার্থক্য সাধারণ লোকেরা বোঝে না। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য। প্রথম বড় পার্থক্য এই যে হাদিয়া দেওয়ার নিয়তের মধ্যে আল্লাহর ওয়াস্তে মহব্বত ছাড়া দুনিয়ার স্বার্থ বা কোনো রকম সাহায্য পাওয়ার আশা থাকে না। পক্ষান্তরে ঘুষ দেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে কিছু স্বার্থ হাসিল করা এবং সাহায্য বা সুবিধা পাওয়া। দ্বিতীয় পার্থক্য এই যে রাষ্ট্র জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স বসিয়ে টাকা আদায় করে জনগণেরই খেদমত করার জন্য বেতন দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে। এসব বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর ওয়াজিব হলো, যে কাজের জন্য তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে, সে কাজ তাকে করে দেওয়া। এর বিনিময়ে উপরি কিছু গ্রহণ করতে পারবে না। তাদের কষ্ট দিতে পারবে না। সবাইকে সমান চোখে দেখে নিঃস্বার্থ ও নিরপেক্ষভাবে তাদের কাজ করে দিতে হবে। ওই বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি তাদের নিজ নিজ এলাকায় জনগণের কাছ থেকে উপহার নেয়, জনগণের বাড়িতে দাওয়াত খায়, জনগণের কাছ থেকে কোনো হাদিয়া, তোহফা গ্রহণ করে বা তাদের ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীর জন্য মিষ্টি বা নাশতা খাবার গ্রহণ করে, তবে তার সবই ঘুষ হবে। হারাম হবে। আমানতের খেয়ানত হবে। গোনাহে কবিরা হবে। ’ (বেহেশতি জেওর-পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০৮)
ইবাদত কবুল হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে হালাল রুজি। এ জন্য প্রত্যেক মুসলমানের পক্ষে হালাল রুজি অন্বেষণ করা ফরজ। রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হালাল রুজি দ্বারা তার পরিবার প্রতিপালনের চেষ্টা করে থাকে, সে আল্লাহর পথে যোদ্ধার মতো। যে ব্যক্তি নিজেকে সংযত রেখে দুনিয়ায় হালাল রুজি অন্বেষণ করে, সে শহীদদের পদমর্যাদায় অবস্থিত। তিনি আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি ৪০ দিন ধরে হালাল দ্রব্য ভক্ষণ করে, আল্লাহ তার হৃদয়কে জ্যোতির্ময় করেন এবং তার অন্তর থেকে তার মারফতে হেকমতের ফোয়ারা প্রবাহিত করে দেন। (ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন, হালাল-হারাম অধ্যায়, পৃষ্ঠা-২৬৮)
অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ আল্লাহর রাস্তায় দান করলেও এর কোনো মূল্য নেই। এ সম্পর্কে হাদিসে উল্লেখ আছে—আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি হারাম ধন-সম্পদ উপার্জন করে তা থেকে দান করলে তা কখনো কবুল করা হয় না এবং তার জন্য সে মাল বরকতপূর্ণও হয় না। তার পরিত্যক্ত হারাম ধন-সম্পদ তার জন্য জাহান্নামের পাথেয় ছাড়া আর কিছুই হয় না। অর্থাৎ এর দ্বারা পরকালীন কল্যাণ ও মঙ্গল লাভ করা যায় না। আল্লাহ তাআলার চিরন্তন নিয়ম এই যে তিনি কখনো মন্দ দ্বারা মন্দ দূরীভূত করেন না। বরং তিনি ভালো দ্বারা মন্দকে অপনোদন বা দূরীভূত করেন। নাপাক, নাপাক বা নোংরা বস্তুকে দূরীভূত করে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করতে পারে না।
হালাল উপার্জিত অর্থ থেকে কাউকে দান করে বা কর্জে হাসানা দিয়ে তার বিনিময়ে কিছুই গ্রহণ করা যাবে না। অন্য হাদিসে হুজুর (সা.) ইরশাদ করেন, অতিসত্বর এমন এক জমানা আসবে, যখন মানুষ এ কথায় ভ্রুক্ষেপ করবে না যে এটা হালাল না হারাম মালের। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কাউকে ঋণ (কর্জ) দেয়, আর গ্রহীতা যদি তাকে কোনো তোহফা দেয় কিংবা যানবাহনে আরোহণ করতে বলে, তখন সে যেন তার তোহফা কবুল না করে এবং তার সওয়ারিতেও আরোহণ না করে। অবশ্য আগে থেকে যদি উভয়ের মধ্যে এরূপ লেনদেনের দ্বারা চলে আসে, তবে তা ভিন্ন কথা। ’ (ইবনে মাজাহ)
ইমাম গাযালি (রহ.) বলেন, বিনা চাওয়া বা যাচনায় যা পাওয়া যায় তা গ্রহণ করার ব্যাপারে তিনটি দিক লক্ষণীয়। এক. সম্পদ। দুই. দাতার উদ্দেশ্য। তিন. গ্রহীতার উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এটা দেখতে হবে যে মাল হালাল না হারাম। দ্বিতীয়ত, দাতার উদ্দেশ্য দেখা—কোন উদ্দেশ্যে বা নিয়তে দিচ্ছেন। হাদিয়া, না অন্য কোনো যশ বা অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু যদি হাদিয়ার দ্বারা পারস্পরিক মহব্বত ও সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্দেশ্য হয়, তবে তা গ্রহণ করা সুন্নত। যদি দানের প্রতিদান চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে সে হাদিয়া ফেরত দেওয়াই উত্তম। হাদিয়া কবুল করার ব্যাপারে খুব লক্ষ করতে হবে যে দাতার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে কি না, যেমন—কর্জের সুরতে যদি এ উদ্দেশ্য হয় যে হাদিয়া দিলে কর্জের ব্যাপারে আর তাগাদা করবে না, এ উদ্দেশ্যের কারণে তা সুদের সঙ্গে ঘুষও হয়ে যাবে।
পক্ষান্তরে মা-বাবা, ওস্তাদ, পীর-মাশায়েখ যাদের অনুগ্রহ শোধ করা যায় না, যারা ইসলামী শিক্ষা দান করেন, কোরআন-হাদিস পড়িয়ে, সত্য প্রচার করে ইসলাম ধর্মকে চিরজীবিত করে রেখেছেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যখন এঁদের কারো জন্য কোনো বেতন নেই, তখন তাঁদের দান করে কোনো কাজ উদ্ধার করে নেওয়ার আশা নেই। কাজেই তাঁদের হাদিয়া-তোহফা দেওয়া ঘুষ নয়। বরং অতি বড় পুণ্যের কাজ। কেননা তাঁদের যা কিছু দান করা হয়, তা শুধু এক আল্লাহর মহব্বতে দান করা হয়। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে দান করা হয় না। (বেহেশতি জেওর, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৮)
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের হাদিয়া বা তোহফা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। শুধু শরিয়তের দৃষ্টিতে যা গ্রহণযোগ্য, তা-ই যেন আমরা গ্রহণ করি। আর শরিয়তের দৃষ্টিতে যা গ্রহণ করা যাবে না, আখিরাতকে সামনে রেখে তা থেকে আমরা যেন দূরে থাকি। সৎ ব্যক্তিদের প্রতিটি পদক্ষেপে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।