সিলেট বিভাগের নদ-নদীতে পানি বাড়া অব্যাহত আছে। বিভিন্ন নদ–নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে জেলার মানুষের মধ্যে বন্যা আতঙ্ক বাড়ছে।
মৌলভীবাজারের মনু ও হবিগঞ্জের খোয়াই নদের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
ইতিমধ্যে দুই লক্ষাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। তবে সিলেট ও সুনামগঞ্জে নদ-নদীর পানি গতকাল বৃহস্পতিবার কিছুটা বাড়লেও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।
মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সারা দেশের সঙ্গে সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর সিলেট থেকে কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানান রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মো. নুরুল ইসলাম।
মনু নদে ক্রমাগত পানি বাড়ায় মৌলভীবাজার-শেরপুর-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। সড়কের বালিয়াকান্দি ও শাহবন্দর এলাকায় বাঁধ যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। এ ছাড়া মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের একাধিক স্থান পানিতে তলিয়ে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
পাউবো মৌলভীবাজার কার্যালয় জানায়, গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় মনু নদের পানি রেলসেতুর বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ও চাঁদনীঘাটে ১১৯ সেন্টিমিটার, ধলাই নদে রেলসেতুর কাছে ২২ সেন্টিমিটার, কুশিয়ার নদী শেরপুরে ১১ সেন্টিমিটার এবং জুড়ী নদীর ভবানীপুরে ১৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
স্থানীয় বাসিন্দারা গণমাধ্যমকে জানান, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে রাজনগর উপজেলার মুনসুরনগর ইউনিয়নের কদমহাটা এলাকায় পানি উপচে মনু নদ প্রকল্পের বাঁধের একটি স্থান ভেঙে যায়। একই এলাকায় পাশাপাশি আরও তিনটি স্থান দিয়ে পানি উপচে বের হচ্ছে। এতে ফসলের মাঠ ডুবছে। বাড়িঘরে পানি উঠছে। এর আগে বুধবার রাতে রাজনগরের শ্বাসমহল এলাকায় মনু সেকেন্ডারি বাঁধ (নদসংলগ্ন বাঁধ) ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢোকে। অনেকেই কদমহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কদমহাটা উচ্চবিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
কদমহাটার বন্যাকবলিত জেলি বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাত তিনটার দিকে ঘরে পানি ঢুকছে। পানি এরপর আর সময় দিছে না। তুরাতুরি (অল্প কিছু) যা পারছি, লইয়া বাইর অইছি (নিয়ে বের হয়েছি)। এখন অন্য জায়গায় উঠছি। ’
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলার সাত উপজেলায় আনুমানিক ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ৬ হাজার ৬৫ জন। ইতিমধ্যে ৪৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য ২৮৫ মেট্রিক টন চাল এবং ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
মনু নদে পানি বাড়তে থাকায় মৌলভীবাজার শহরবাসীর মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। বুধবার রাতে শহর প্রতিরক্ষা দেয়াল চুইয়ে এম সাইফুর রহমান সড়কের পশ্চিম বাজারের দিকে পানি ঢুকতে থাকে। স্থানীয় উদ্যোক্তা জাহেদ আহমদ চৌধুরী বলেন, পানি প্রবেশ বন্ধে স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, অনেক ক্রিকেটার, অনেক তরুণ, ব্যবসায়ী সহযোগিতা করেছেন। পাউবো বস্তা দিয়েছে। সবাই মিলে পানি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।
জেলার কুলাউড়ার টিলাগাঁও ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া এলাকায় বুধবার গভীর রাতে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে মনু নদের বাঁধ ভেঙে যায়। পৃথিমপাশা ইউনিয়নে নতুন করে আরও দুটি স্থানে নদের বাঁধ ভেঙে গেছে। টিলাগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শুধু আমার ইউনিয়নে বাঁধের তিনটি স্থান ভেঙে গেছে। ১৯টি গ্রাম বন্যাপ্লাবিত। অন্তত সাড়ে আট হাজার মানুষ পানিবন্দী। ’
হবিগঞ্জের খোয়াই নদের পানি গতকাল বেলা তিনটায় বিপৎসীমার ২৭৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে শহর রক্ষা বাঁধ। বাঁধ উপচে ইতিমধ্যে সদর উপজেলার তিনটি পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকছে। বালুর বস্তা দিয়ে পানি ঠেকানোর চেষ্টা করছে পাউবো। শায়েস্তাগঞ্জে অবস্থিত রেলসেতু বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।
হবিগঞ্জ শহর লাগোয়া জালালাবাদ এলাকায় নদের পুরোনো ভাঙন দিয়ে পানি ঢুকে নোয়াগাঁও গ্রামসহ আশপাশে কয়েকটি গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি এই পানি জালালাবাদ হয়ে হাওরে ঢুকছে। এ ছাড়া কুশিয়ারা ও কালনী কুশিয়ারা নদীর পানিও বেড়েছে। তবে সেগুলোর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) প্রভাংশু সোম মহান গণমাধ্যমকে বলেন, বন্যার কারণে সদর, চুনারুঘাট, মাধবপুর, শায়েস্তাগঞ্জ ও নবীগঞ্জ উপজেলার ৮ হাজার ২৪০ জন মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন ১১৬ জন। পানিবন্দী মানুষদের জন্য ত্রাণের চাহিদা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সিলেটে নদ-নদীর পানি কিছুটা বাড়লেও তা আশঙ্কাজনক নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল বৃষ্টি কিছুটা কমায় পানি খুব একটা বাড়েনি। এখন পর্যন্ত জেলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তবে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যার শঙ্কা আছে বলে জানিয়েছে পাউবো।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুরমা, কুশিয়ারা, লুভা, সারি, ডাউকি, সারি-গোয়াইন, ধলাইসহ জেলার সব কটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে গতকাল বেলা তিনটা পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর চারটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ০৬ সেন্টিমিটার থেকে শূন্য দশমিক ৭৩ সেন্টিমিটার ওপরে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর পয়েন্টে গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় নদীর পানি বেড়েছে ৩ সেন্টিমিটার। নামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার জানান, সুনামগঞ্জে ও উজানে বৃষ্টি কম হওয়ায় পানি তেমন একটা বাড়েনি।