ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের ওপর নানামুখী চাপ অব্যাহত থাকায় দেশে নতুন বিনিয়োগ অনেকটা স্থবির হয়ে আছে। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, আইন শৃঙ্খলায় অস্বস্তিসহ নানা কারণে উৎপাদন ব্যবস্থায় গতিহীনতা বিরাজ করছে। তার ওপর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কারখানায় হামলা, হয়রানিমূলক মামলা, ব্যাংক হিসাব জব্দ, বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ভিত্তিহীন নানা প্রচারণায় ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা ভীতসন্ত্রস্ত। এসব কারণে কেউ নতুন বিনিয়োগে ভরসা পাচ্ছেন না।
দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে বেসরকারি খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশে মোট কর্মসংস্থানে সরকারি চাকরির অংশীদারি মাত্র ৩.৮ শতাংশ। বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ১৪.২ শতাংশ। প্রায় ৬১ শতাংশের কর্মসংস্থান হচ্ছে ব্যক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে। বাকি ২১ শতাংশ অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত। বেসরকারি খাত ও ব্যক্তি উদ্যোগ সংকটে পড়ায় বর্তমানে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রায় বন্ধ। পাশাপাশি এসব খাতে আগে থেকে নিয়োজিতরাও ঝুঁকিতে আছেন।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যে যে সংকট চলছে তা দূর করতে ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এসবের অভাবে বিনিয়োগ টেকসই হবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সামগ্রিক অর্থনীতির একটা উন্নয়ন দরকার। তা না হলে বর্তমান বিনিয়োগ টেকসই হবে না।’
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে হলে উৎপাদনমুখী শিল্প ও সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যেখানে মূল ভূমিকা রাখবে বেসরকারি খাত। আর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ গতিশীল করতে হলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরাজমান ভয়ভীতি বা অস্বস্তি কাটাতে হবে। সেই সঙ্গে অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন, ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজারকে গতিশীল করা, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান হলে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি বাড়বে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে সত্যিকার অর্থে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। প্রথমত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো বড়ভাবে রয়ে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা সীমিত। রপ্তানি বাজারেও এক ধরনের অনিশ্চয়তা আছে। সেই সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ সীমিত ও উচ্চমূল্য। তার ওপর ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতি ও অনিশ্চয়তাও আছে।’ তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পুরনো যে বিনিয়োগগুলো আছে, সেগুলো যেন ধরে রাখা যায়। যেসব প্রতিষ্ঠান এখন উৎপাদনে আছে সেগুলো যেন টিকে থাকতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। রপ্তানির সুযোগও সীমিত। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা চাপে আছেন। সেটা কাটাতে না পারলে বর্তমানে যে কর্মসংস্থান আছে সেটাও বন্ধ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই সরকারের নতুন বিনিয়োগের চেয়ে পুরনো যেসব বিনিয়োগ রয়েছে সেগুলো যাতে টিকে থাকতে পারে সেটা দেখা দরকার।’
পরিসংখ্যান বলছে, কাজ করার ক্ষমতা থাকার পরও দেশে পৌনে ২ কোটির বেশি মানুষের নিয়মিত রোজগারের নিশ্চয়তা নেই। এর মধ্যে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ সম্পূর্ণ বেকার। অর্ধবেকারের সংখ্যা ১৫ লাখ। এ ছাড়া যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান না হওয়ায় অনিয়মিত কাজে যুক্ত আছেন আরও ১ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ। অন্যদিকে প্রতি বছর নতুন প্রায় ২১ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে দেশে-বিদেশে কাজ পাচ্ছেন ১৩ লাখ। বাকি প্রায় ৮ লাখের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে শ্রমশক্তির প্রায় ২৫ শতাংশই রোজগারের জন্য নিজের সামর্থ্য পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছেন না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর শোভন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগ নিশ্চিত করা নতুন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৭ দশমিক ৩৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ লক্ষ্য পূরণ হওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।