বাংলাদেশে থাকা অবৈধ বিদেশিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে বিদেশিদের বৈধতা অর্জনের জন্য আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যাঁরা এই সময়ের মধ্যে বৈধ হবেন না তাঁদের গ্রেপ্তারসহ শাস্তির আওতায় আনা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের কাছে এক লাখ ২০ হাজার বিদেশি নাগরিকের তথ্য রয়েছে।
তবে প্রকৃত সংখ্যা চার-পাঁচ লাখের মতো হবে বলে জানা গেছে, যাঁদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যাই বেশি।
বিদেশি এসব নাগরিকের অনেকে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে গ্রেপ্তারের পর বর্তমানে ৪৭২ জন কারাগারে রয়েছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, কোনো বিদেশি নাগরিককে অবৈধভাবে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৬৯টি দেশের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, যাঁদের পাসপোর্ট ও ভিসার মেয়াদ অনেক আগেই উত্তীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে ভারতের প্রায় ২৪ হাজার এবং চীনের আট হাজার নাগরিক অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। আর পাকিস্তানের নাগরিক রয়েছেন প্রায় দুই হাজার। কানাডা, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়ার মতো উন্নত দেশের কিছু নাগরিকও অবৈধভাবে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের বহিরাগমন ২ ও ৫ শাখার উপসচিব কানিজ ফাতেমা গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে পুলিশের এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) কাজ করে। বিমান, নৌ ও স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন হয়ে যেসব বিদেশি বাংলাদেশে আসেন সেই হিসাব এসবির কাছে রয়েছে।’
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, বিদেশিদের তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এক লাখ ২০ হাজারের মতো বিদেশি নাগরিকের তথ্য রয়েছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ৫০ হাজারের বেশি বিদেশি অবৈধ হয়ে গেছেন। সারা দেশে বিদেশিদের তালিকা করা হচ্ছে।
অন্য একটি সূত্র জানায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দেশে অবস্থানরত বৈধ নাগরিকদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিক ছিলেন ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক ভারতীয় নাগরিক চলে চলে গেছেন। আবার কিছু নাগরিক এসেছেনও। তাঁরা আসা-যাওয়ার মধ্যে আছেন। ফলে বর্তমানে কতসংখ্যক ভারতীয় নাগরিক এ দেশে কাজ করছেন তার হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে ভারতের পরেই চীনের অবস্থান। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এ দেশে অবস্থানরত চীনা নাগরিকের সংখ্যা ১১ হাজার ৪০৪।
কারা অধিদপ্তরের এআইজি মো. জান্নাত-উল-ফরহাদ কালের কণ্ঠকে জানান, সারা দেশের কারাগারগুলোতে ৪৭২ জন বন্দি রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি বন্দি ভারতের। এর পরই আছে মায়ানমার ও পাকিস্তানের নাগরিক। এ ছাড়া নাইজেরিয়া, উগান্ডা, ঘানাসহ কয়েকটি দেশের বন্দি রয়েছেন বাংলাদেশের কারাগারে।
এসবির ওই কর্মকর্তা জানান, অবৈধ বিদেশিদের শনাক্ত করে নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করার কার্যক্রম একটি রুটিন ওয়ার্ক। অবৈধ বিদেশিদের অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী তাঁদের স্টপ লিস্ট ও ব্ল্যাক লিস্ট করা, অবৈধদের শনাক্ত করে আইন ও বিধি অনুযায়ী জরিমানা আদায় এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার কার্যক্রম চলমান। যেসব বিদেশি অবৈধভাবে বিভিন্ন কাজ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থেকে অর্থ উপার্জন করেন তাঁদের উপার্জনকে করের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সারা দেশে অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিদেশি কর্মী কাজ করেন দেশের পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় অনেক বিদেশি কর্মরত। কাজের অনুমতি না থাকলেও বিজনেস ভিসায় এসে অনেকে বেআইনিভাবে দেশের বিভিন্ন কম্পানিতে চাকরি নেন। এ ধরনের ভিসায় সবচেয়ে বেশি আসেন চীনের নাগরিকরা। বিভিন্ন প্রকল্প এবং চীনা নাগরিকদের বিনিয়োগ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁরা কাজ করেন। এ ছাড়া ভারতের অনেকে ভ্রমণ ভিসায় এসেও এখানে নানা কাজ বা চাকরিতে যুক্ত হন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশিকে আটকের পর দেখা যায় তাঁর কাছে কোনো পাসপোর্টই নেই। অনেক সময় তাঁরা ইচ্ছা করে পাসপোর্ট গোপন করেন বা ফেলে দেন। এ অবস্থায় এই বিদেশি নাগরিকদের ফেরত পাঠানোর আগে নাগরিকত্ব নির্ধারণের প্রয়োজন হয়, যা সময়সাপেক্ষ। আবার অনেক দেশের দূতাবাস ঢাকায় নেই। এমন দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব যাচাই করা আরো বেশি জটিল। এ ছাড়া অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তাঁরা মামলার অজুহাতেও এ দেশে থেকে যান। তাঁদের রাখার জন্য আলাদা ডিটেনশন সেন্টারও নেই।
গত বছর ২৮ মে দেশে অবস্থানরত বৈধ ও অবৈধ বিদেশি কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিরূপণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এসব বিদেশি কর্মী কিভাবে ও কোন চ্যানেলের মাধ্যমে তাঁদের অর্থ দেশের বাইরে পাঠান, সে বিষয়েও অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি
গত ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকদের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে বৈধতা অর্জনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। অন্যথায় অবৈধভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনেক বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন বা কর্মরত রয়েছেন। অবৈধভাবে অবস্থানরত বা কর্মরত ভিনদেশি নাগরিকদের ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থান করার বা কর্মরত থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের জন্য বিজ্ঞপ্তিতে অনুরোধ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার জন্যও বিজ্ঞপ্তিতে অনুরোধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর অবৈধভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
অবৈধ বিদেশিদের থাকতে দেওয়া হবে না