নিউজ ডেস্ক:
দুই বছরেও শেষ হয়নি বিজ্ঞান মনস্ক লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার তদন্ত।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন অভিজিৎ। এই হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পূর্ণ হবে আগামীকাল। এই দুই বছরে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালতের ৮০টি ধার্য তারিখ পার হয়েছে। সর্বশেষ গত ২২ ফেব্রুয়ারি এ মামলার প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু এদিনও ডিবি পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য আদালত আগামী ২৭ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেছেন ।
এদিকে তদন্তে হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদঘাটনের দাবি করা হলেও এর মূল পরিকল্পনাকারী এখনও অধরাই রয়ে গেছে বলে জানিয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ (ডিবি)। সরাসরি কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া কোনো খুনিকেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলামত ও আসামিদের ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পরও তদন্তের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। গোয়েন্দা পুলিশের দাবি, তারা খুনিদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। যেকোনো দিন খুনিরা ধরা পড়বে। সম্প্রতি মালয়েশিয়া ফেরত জঙ্গি রেদোয়ানুল আজাদ রানা ধরা পড়েছে। সে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) স্লিপার সেলের সমন্বয়ক ও অভিজিৎসহ ছয়জন ব্লগার হত্যার সঙ্গে জড়িত।
২১ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এক মামলায় তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তবে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী এবিটি প্রধান বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া এখনও অধরা রয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির (দক্ষিণ) রমনা জোন টিমের প্রাক্তন পুলিশ পরিদর্শক (বর্তমানে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট) মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘এ মামলায় এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে এক আসামি জামিনে থাকাকালীন মারা গেছেন। তবে গ্রেপ্তার করা আসামিদের মধ্যে সরাসরি কেউ কিলিং মিশনে ছিল কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়াকে শনাক্ত করা গেছে। এখন শুধু গ্রেপ্তারের অপেক্ষা।
এদিকে মামলার তদন্তে ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ জব্দকৃত আলামত ১টি হার্ডডিক্স, ১টি ল্যাপটপ ও আসামি ফারাবীর কাছ থেকে প্রাপ্ত দুটি মোবাইল সেট এফবিআই, সিআইডি ও বাংলাদেশ পুলিশ দিয়ে পরীক্ষা করানোর জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। একই সঙ্গে ২১শে বইমেলার ভিডিও ফুটেজ এফবিআইয়ের দিয়ে পরীক্ষা করানোর জন্য পৃথক আরেকটি আবেদন করা হয়। এরপর আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে তা এফবিআইসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের ডিএনএ নমুনা এফবিআইয়ের কাছ থেকে সংগ্রহের অনুমতি দেন অদালত। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৮ মে আসামিদের ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টও সংগ্রহ করা হয়।
মামলা তদারককারী কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ‘সিসি টিভি ফুটেজ দেখে জড়িতদের শনাক্ত করা গেছে। মূল স্পটে ৬ থেকে ৭ জন ছিল। আর ঘটনাস্থালের আশপাশেও বেশ কয়েকজন ছিল। এ হত্যাকাণ্ডটি মূলত একটি সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে হয়েছে। এ মামলার মোটিভ সবই উদঘাটন করা গেছে। কিলিং মিশনে সরাসরি উপস্থিত থাকা এবিটি নেতা শরিফুল ইসলাম মুকুল পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো আলামত ও আসামিদের ডিএনএ রিপোর্টও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ভিডিও ফুটেজের তথ্য অনুসারে ফিল্ডে থাকা আরো পাঁচজনের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। এবিটির অপারেশনাল প্রধান বরখাস্ত মেজর জিয়াসহ কিলিং মিশনের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করা আসামিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এখন শুধু আসামি গ্রেপ্তারের সাপেক্ষেই মামলার চার্জশিট দাখিল করা হবে।
এদিকে দীর্ঘদিনেও এ মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় নিহতের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ। হত্যার বিচার না পাওয়ায় দুবছরের মধ্যে দেশে আসেননি নিহতের স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বন্যা আহমেদ।
অভিজিৎ রায়ের বাবা ও মামলার বাদী অধ্যাপক ড. অজয় রায় বলেন, ‘অভিজিৎ হত্যার দুবছর পার হতে চলল। কিন্তু এখনও তদন্তই শেষ হয়নি। সব মিলিয়ে দীর্ঘ তদন্ত একেবারেই নৈরাশ্যজনক বলব না। আবার খুব যে একটা আশাব্যঞ্জক সে কথাও বলা যাবে না। যতদিন না খুনিদের গ্রেপ্তার করে বিচারে সোপর্দ করা হচ্ছে ততদিন আশার কিছু নেই। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন দ্রুত হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচারে সোপর্দ করে, এটাই চাওয়া।’
তিনি আরো বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত আসামিদের ধরে তারপর মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে এ তো কোনো কথা নয়। তাদের অনুপস্থিতিতেও (আসামি গ্রেপ্তার না হলেও) মামলার চার্জশিট দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তারা (তদন্ত সংস্থা) বলছে, তারা খুনিদের ধরার চেষ্টা করছে।’
অজয় রায় আরো বলেন, ‘অভিজিতের স্ত্রী বন্যা যুক্তরাষ্ট্রে আছে। হত্যাকাণ্ডের পর অভিমানে সে দেশ ত্যাগ করেছে, আর ফেরেনি। অভিজিতের হত্যার বিচার না পেলে সে দেশে ফিরবে না বলেও জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অভিজিতের দ্বিতীয় মৃত্যুবাষির্কীতে এক আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বন্যা অংশ নেবে।’
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্র থেকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ দেশে আসেন। ওই বার একুশে বইমেলায় তার দুটি বই প্রকাশিত হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অভিজিৎ বইমেলায় যান। মেলা থেকে ফেরার সময় রাত সাড়ে ৮টায় টিএসসি চত্বরের সামনে স্ত্রী বন্যা আহমেদসসহ হামলার শিকার হন অভিজিৎ। হামলায় অভিজিৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় ও তার মাথার মগজ বের হয়ে যায়। পরে হাসপাতালে নিলে মস্তিস্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রাত সাড়ে ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান অভিজিৎ। হামলায় চাপাতির আঘাতে বন্যার বা হাতের বৃদ্ধাঙুলও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এ ঘটনায় অভিজিতের বাবা অজয় রায় বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এ মামলায় এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-শফিউর রহমান ফারাবী, মো. সাদেক আলী ওরফে মিঠু, মোহাম্মদ তৌহিদুর রহমান ওরফে গামা, আমিনুল মল্লিক, জুলহাস বিশ্বাস, মো. জাফরান হাসান, মান্না ইয়াহিয়া ওরফে মান্নান বাহি ও মো. আবুল বাশার। এদের মধ্যে আবুল বাশার জামিনে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন।