নিউজ ডেস্ক:
দারিদ্র্য একটি সামাজিক ও মানবিক সমস্যা। সম্ভবত পৃথিবীতে মানব সভ্যতা যতটা প্রাচীন, দারিদ্র্য সমস্যাও ততটাই পুরনো। বর্তমান বিশ্বে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও মানবসেবায় নিয়োজিত অসংখ্য ব্যক্তি ও সেবা সংগঠন বিশ্বমানবতাকে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্যে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে আসছে। বিশেষত জাতিসঙ্ঘ দারিদ্র্যকে অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। অথচ বাস্তবে দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এক সময় মুসলিম খলিফা ও শাসকগণ তাদের প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
দারিদ্র্যের সংজ্ঞা : দারিদ্র্য একটি বহুমাত্রিক বিষয়। সাধারণভাবে জীবনধারণের মৌলিক চাহিদা ও নি¤œতম সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার অপারগতাকেই দারিদ্র্য বলা হয়। জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় দৈনিক এক ডলার আয়কে দারিদ্র্যসীমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, ‘চাহিদা অনুসারে মৌলিক বিষয়গুলো অর্জন করতে পারার যে স্বাধীনতা, তার অভাবই হলো দারিদ্র্য।
কুরআন ও হাদিসে বিশেষত জাকাত বণ্টনের খাত আলোচনায় দরিদ্র ব্যক্তিকে ‘ফকির’ ও ‘মিসকিন’- এ দু’টি স্তরে বিন্যস্ত করা হয়েছে। মূলত ফকির বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যার জীবিকা নির্বাহের কোনো উপায়-উপকরণ নেই, যে সর্বতোভাবে নিঃস্ব। আর মিসকিন বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যে নিজের প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থসম্পদ পায় না, তাকে যে সাহায্য করতে হবে তাও বোঝা যায় না এবং প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে চাইতেও পারে না। প্রকৃতপক্ষে এরা হচ্ছে সম্ভ্রান্ত মানুষ, তবে দরিদ্র ও অসচ্ছল।
দারিদ্র্য সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি : দারিদ্র্যের কশাঘাত ও ক্ষুধার নির্মম যাতনা মানুষকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে, মানবতাবোধের বিলুপ্তি ঘটায়, কখনো সন্তানকে বিক্রি করতে আবার কখনো হত্যা করতে বাধ্য করে। এ ছাড়াও মানুষ তার বোধ-বিশ্বাস, ব্যক্তিত্ব এক কথায় মূল্যবোধের বিনাশ ঘটায়। এমনকি দারিদ্র্য মানুষকে কুফরির দিকে নিয়ে যায়। তাই ইসলাম প্রতিটি মানুষকে তার ভাগ্যের উন্নতির জন্য চেষ্টা করার এবং নিজের অধিকার আদায়ে পিছিয়ে না থাকার ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেনÑ ‘এবং দুনিয়া হতে তোমার অংশ ভুলে যেও না’ (সূরা কাসাস : ৭৭)। বর্ণিত আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ভাগ্যের উন্নতির জন্য চেষ্টা করার এবং নিজের অধিকার আদায়ে পিছিয়ে না থাকার ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। মহানবী সা: দরিদ্রতা থেকে মহান আল্লাহর কাছে মুক্তি প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট কুফর ও দারিদ্র্য থেকে পানাহ চাচ্ছি। এ সময় এক ব্যক্তি বলল, আপনি কি এ দুটোক সমপর্যায়ের মনে করেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ’ (সুনানে নাসায়ী)।
নৈতিকতার ওপর দারিদ্র্যের প্রভাব : দারিদ্র্য ঈমানের জন্য যেমন হুমকি, নৈতিকতার ক্ষেত্রেও কিন্তু কোনো অংশে কম হুমকি নয়। কারণ দারিদ্র্য মানুষকে এমন সব অনভিপ্রেত কাজ করতে প্ররোচিত করে যা নৈতিকতা বিরোধী। দারিদ্র্যের প্রভাব থেকে পারিবারিক জীবনও মুক্ত নয়। কেননা পারিবারিক বন্ধন স্থাপন ও সুখী পরিবার গঠনে তা একটি বড় অন্তরায়। তাই কুরআন মাজিদে এ শ্রেণীর লোককে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পবিত্রতা অবলম্বন ও ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যাদের বিবাহের সামর্থ্য নেই আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে অভাব মুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে’ (সূরা নূর : ৩৩)।
দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর কর্ম কৌশল : একটি পূর্ণঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে ইসলাম দারিদ্র্য বিমোচনে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণে ইহা প্রমাণিত যে, ইসলামি বিধানের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন পরিপূর্ণ দারিদ্র্য দূরীকরণে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। সুতরাং আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামের সুমহান আদর্শ উৎসারিত কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এই কর্মকৌশলের নি¤েœাক্ত বিষয়গুলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
কর্ম-সংস্কৃতি গড়ে তোলা : ইসলাম চেয়েছে প্রতিটি মানুষ জীবিকার জন্য কাজ করুক। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে রিজিক অনুসন্ধানের কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো’ (সূরা জুমু’আ : ১০)।
স্বচ্ছল আত্মীয় কর্তৃক দরিদ্রদের ভরণ-পোষণ : সামর্থ্যবান আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব রয়েছে তাদের গরিব অসহায় স্বজনকে সাধ্যমত সাহায্য করা। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন’ (সূরা নাহ্ল : ৯০)।
জাকাত : সমাজ থেকে স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য দূর করার জন্য ইসলাম জাকাত ব্যবস্থা চালু করেছে। জাকাত হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের চিরন্তন বিধান। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ। যারা বিনয় নম্র নিজেদের সালাতে। যারা অর্থহীন কথা ও কর্ম থেকে বিরত থাকে। যারা জাকাত দানে সক্রিয়’ (সূরা মু’মিনূন : ১-৪)।
সুষম বণ্টন ব্যবস্থা : ইসলামের দৃষ্টিতে দারিদ্র্য সমস্যার মূল কারণ এই নয় যে, পৃথিবীতে সম্পদের অভাব বরং আসল কারণ হচ্ছে সুষ্ঠু বণ্টনের অভাব। আল্লাহ বলেন, ‘যেন ধন-সম্পদ তোমাদের ধনীদের মধ্যেই কেবল আবর্তিত হতে না থাকে’ (সূরা হাশর : ৭)।
সুদ নিষিদ্ধকরণ : ইসলাম সুদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ব্যবসাকে বৈধ ঘোষণা করেছে। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল এবং সুদকে করেছেন হারাম’ (সূরা বাকারা : ২৭৫ )।
উৎপাদন ব্যবস্থা দক্ষকরণ : ইসলাম উৎপাদনের ওপর যথোচিত গুরুত্বারোপ করেছে এবং এজন্য মানবসম্পদ ও বস্তুগত সম্পদের যথাযোগ্য ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে। মহানবী সা: বলেছেন, ‘কোন সুস্থ কর্মক্ষম ব্যক্তির জন্য সাদাকাহ গ্রহণ বৈধ নয়’ (আবু দাউদ)।
শ্রমের মাধ্যমে : ইসলামের দাবি হচ্ছে সমাজের প্রতিটি সক্ষম মানুষ কাজ করবে এবং অলস জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে না। তাই রিজিকের অন্বেষণে ইসলাম প্রত্যেককে পৃথিবী চষে বেড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা এর দিগ-দিগন্তে বিচরণ করো এবং তাঁর প্রদত্ত জীবনোপকরণ হতে আহার্য গ্রহণ করো’ (সূরা মুলক :১৫)।
উশরের মাধ্যমে : উশর-এর অর্থ এক দশমাংশ। ইসলমি পরিভাষায় জমির ফসলের জাকাতকে উশর বলা হয়। আল্লাহ বলেন- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন করো এবং আমি ভূমি হতে যা তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় করো এবং তার নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার ইচ্ছা করো না’ (সূরা বাকারা : ২৬৭)।
করজে হাসানার মাধ্যমে : যে ঋণ বিনা সুদে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে প্রদান করা হয় তাকে করজে হাসানা বলা হয়। এর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের আর্থিক সহযোগিতা করা যায়।
প্রতিবেশীর অধিকার আদায়ের মাধ্যমে : প্রতিবেশীর অধিকার আদায় করার বিষয়টি কুরআন ও হাদিসে বিশেষ তাকিদ সহকারে স্থান পেয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোনো কিছুকে তাঁর সাথে শরিক করবে না এবং পিতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে’ (সূরা নিসা : ৩৬)।
মহানীব সা: প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে বলেন, ‘সে ব্যক্তি মুমিন নয় যে তৃপ্তি সহকারে আহার করে অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে’ (আল-মিশকাতুল মাসাবিহ)।
ভিক্ষার হাত কর্মীর হাতে পরিণত করার মাধ্যমে : ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তি অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। মহানবী সা: বলেছেন- ‘যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! তোমাদের মধ্যকার কারো তার পিঠে বহন করে কাঠের বোঝা এনে বিক্রি করা কারো কাছে ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে উত্তম। কারণ সে যার কাছে প্রত্যাশা করছে সে তাকে দিতেও পারে আবার নাও দিতে পারে’ (সহিহ আল-বুখারি)।
উপসংহার
মানব জীবনে যত সমস্যা প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়া দেয় তন্মধ্যে দারিদ্র্য সমস্যা অন্যতম। এ দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সংস্থা অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তারা কার্যত কোনো অবদান রাখতে পারছে বলে দাবি করা যাচ্ছে না। পক্ষান্তরে ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান তাই তার মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনের সঠিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে- এ প্রত্যাশা একান্তভাবে যুক্তিসংগত। কেননা মহানবী সা: পৃথিবীতে এমন এক মিশন নিয়ে এসেছিলেন যার উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা ও দারিদ্র্য মুক্ত বিশ্ব কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর সেই মিশন তিনি পূর্ণ করেছিলেন।
ইসলাম এমন সময় পার করেছে যখন জাকাত নেয়ার মতো লোক ছিল না। জাকাত নেয়ার লোক কখন থাকে না, যখন কোনো সমাজে দারিদ্র্য থাকে না। কাজেই কুরআন ও হাদিস নির্দেশিত পন্থা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে অতীতে যেমন দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হয়েছিল, আজও তেমনি দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব- তাতে কোনো সন্দেহ নেই।