দরবেশের ক্ষমতা আর প্রভাবের থাবায় লাখো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হয়েছেন নিঃস্ব। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। যুগের পর যুগ তার নাম আর পুঁজিবাজারের কারসাজি সমার্থক হয়ে গেছে। দেশের ইতিহাসে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়েও বিচার হয়নি।
এই দরবেশের কালো ছায়া থেকে এখনো বেরোতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজার। ১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩১ বছরে শেয়ারবাজারে এমন কোনো বড় কেলেঙ্কারি নেই, যেখানে সালমান এফ রহমানের সম্পৃক্ততা মেলেনি। এসব কাজে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করেছেন তিনি। কারসাজির নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি।
১৯৯৬ সালের ভয়াবহ ধসের নেপথ্যে জুলাই থেকে ডিসেম্বরে জালিয়াতি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অভিযুক্ত সালমান এফ রহমান ও তাঁর কম্পানি জড়িত ছিল বলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্তেও উঠে এসেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কারসাজির অর্থ তিনি পাচারও করেছেন। রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে বেক্সিমকো গ্রুপের স্বত্বাধিকারী সালমান এফ রহমানসহ ২৮ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা করেছে সিআইডি। গতকাল বুধবার অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ তথ্য জানায়।
শাইনপুকুর থেকে সুকুকে যেভাবে কারসাজি
১৯৯৬ সালে শাইনপুকুর সিরামিক ও দোহা সিকিউরিটিজের কেলেঙ্কারিতে জড়ান তিনি। ওই সংক্রান্ত মামলার এখনো তিনি আসামি। শেয়ারবাজার কারসাজি নিয়ে ২০১১ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টেও তাঁর নাম আসে। প্রভাব খাটিয়ে বেক্সিমকো ফার্মার প্রেফারেন্স শেয়ার পাশ করিয়ে নেন তিনি। এই শেয়ারের মাধ্যমে প্রিমিয়ামসহ ৪১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। একই সময় শাইনপুকুর সিরামিকের মাধ্যমে ২৮৬ কোটি এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইলের মাধ্যমে ৬৩৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া জিএমজি এয়ারলাইনসের প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ৩০০ কোটি টাকা নেন তিনি। পরে ওই কম্পানি উধাও হয়ে যায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আর টাকা ফেরত দেননি।
একইভাবে জিএমজি এয়ারলাইনসের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে ২২৮ কোটি ঋণ নেন তিনি। ২০১৩ সালের আইএফআইসি ব্যাংকের টাকায় নেপালের লোকসানি প্রতিষ্ঠানের ১০ টাকার শেয়ার ৭৫ টাকায় কেনেন তিনি। এই প্রক্রিয়ায় সেখানে ১২৫ কোটি টাকা পাচার করা হয়। ২০১১ সালে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে আইএফআইসি মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেন।
সৌদি যুবরাজ নামে ভুয়া এক ব্যক্তি সাজিয়ে ২০০৬ সালে রূপালী ব্যাংক কেনার নাটক সাজান দরবেশ। রূপালী ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৪০০ টাকা থেকে তিন হাজার ৪০০ টাকায় উন্নীত হয়। এই প্রক্রিয়ায় রূপালী ব্যাংকের শেয়ার থেকে ৯০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। গত তিন বছরে শেয়ারবাজার থেকে দৃশ্যমান ছয় হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড তিন হাজার কোটি, আইএফআইসি আমার বন্ড এক হাজার কোটি এবং বেক্সিমকো জিরো কুপন বন্ড ছেড়ে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন। তবে অদৃশ্য ও বেনামি মিলিয়ে তিন বছরেই ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এদিকে সুকুক বন্ড কেনার জন্য বিভিন্ন ব্যাংককে বাধ্য করা হয়।
গত কয়েক বছরে সালমান এফ রহমানের অর্থ পাচারের বিষয়টি সামনে আসে। তাঁর ব্যবসার বড় অংশই দুবাই ও সিঙ্গাপুরে। চীনের পত্রিকার হুরুন গ্লোবালের তথ্য অনুসারে, সালমান এফ রহমানের সম্পদের পরিমাণ দেড় বিলিয়ন ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় তা ১৮ হাজার কোটি টাকা।
বেক্সিমকোর শেয়ার কারসাজি
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আলোচিত বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে কারসাজি পেয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। প্রতিষ্ঠানটির তদন্তে শেয়ারটির কারসাজিতে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তাঁরা হলেন আব্দুর রউফ, ক্রিসেন্ট লিমিটেড, মোসফেকুর রহমান, মমতাজুর রহমান অ্যান্ড দেয়ার অ্যাসোসিয়েটস, জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড, মারজানা রহমান ও ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত বেক্সিমকোর শেয়ারের টার্নওভার মূল্য ছিল চার হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে ভিন্ন ভিন্ন ক্লায়েন্ট কোডের মাধ্যমে যার ৭০ শতাংশের বেশি লেনদেন করেছে এই আট বিনিয়োগকারী।
তদন্তে দেখা গেছে, গ্রুপটি যৌথভাবে রিয়ালাইজড গেইন করেছে ২১৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং আনরিয়ালাইজড গেইন করেছে ৫২৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ২০২২ সালের শেষের দিকে ডিএসইর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে জমা দেওয়া হয়।
এরপর প্রতিবেদনটি শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনে আটকে যায়। কারণ কম্পানিটি সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন এবং কারসাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত কম্পানিগুলোও তাঁরই মালিকানাধীন।
কম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে—ক্রিসেন্ট লিমিটেড, জুপিটার বিজনেস, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড এবং ট্রেডেনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল।
২০২০ সালের ১৯ মার্চ বেক্সিমকোর শেয়ার দর ছিল ১১ টাকা ২০ পয়সা, যা ওই বছরের শেষ দিকে ২২ টাকায় লেনদেন হয়। তার পর থেকে শুরু হয় শেয়ারটির রেকর্ড কারসাজির গল্প। দুই মাসের মাথায় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দাম ওঠে ১০০ টাকায়।
এরপর একই বছরের শেষ দিকে দাম তোলা হয় প্রায় তিন গুণ ১৯০ টাকায়। এই সময় দেখানো হয় রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা। ঘোষণা করা হয় বড় আকারে ডিভিডেন্ড।
প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক তদন্তে প্রমাণিত হয়, ২০২২ সালের শুরুর দিকে বেক্সিমকোর শেয়ারের দামে কারসাজি করে আট বিনিয়োগকারীর একটি গ্রুপ ৮৪৬ কোটি টাকা রিয়ালাইজড ও আনরিয়ালাইজড গেইন করেছে।
এখনো দরবেশের মুরিদরা সক্রিয়
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির সদস্য ইয়াওয়ার সাঈদ বলেন, ‘১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্তে অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার আলোকে কিছুই করা হয়নি। কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। বরং সেসব ‘দরবেশ, পীররা’ দাঁড়ি কামানোর আগ পর্যন্ত পুঁজিবাজার চালিয়েছেন। এখন পুঁজিবাজারে সেই দরবেশ-পীররা নেই। কিন্তু তাঁদের মুরিদরা রয়ে গেছেন। ’
তদন্ত কমিটির প্রধান জিয়া উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কান কোন জায়গায় অনিয়ম দুর্নীতিগুলো হয়েছিল, সেগুলো আমরা বের করব। ’
তদন্ত কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জিসান হায়দার বলেন, ‘শেয়ারবাজারের যেসব দুর্নীতি ও কারসাজি হয়েছে, সেগুলোর যেসব ক্রিমিনাল অফেন্স আছে, এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করব। ’
কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি
পুঁজিবাজারে ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে সম্প্রতি পাঁচ সদস্যের বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের টেরা রিসোর্সেস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়া ইউ আহমেদকে।
বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, সংস্থাটির ১৫ বছরের বিভিন্ন অনিয়ম তদন্তে প্রথম ধাপে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখা হবে। প্রথম ধাপে গঠিত কমিটিকে যে ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে আছে বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক আল ইসতিসনা ও আইএফআইসি গ্যারান্টেড শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ড ইস্যুসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় অনুসন্ধান। এ দুটি বন্ডের সুবিধাভোগী ছিলেন সালমান এফ রহমান।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র ফারহানা ফারুকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শেয়ারবাজারে বড় বড় কারসাজি তদন্তে গঠিত কমিটি ১২টি বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে বড় বড় অনিয়মের ঘটনা উদঘাটিত হবে। কমিটির প্রথম ধাপের যে ৬০ দিন সময় আছে, তার মধ্যে প্রথম পর্যায়ের প্রতিবেদন পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। ’
বাজার ছেড়েছেন লাখো বিনিয়োগকারী
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় ছয় মাসে ব্যালান্স শূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ এক হাজার ৯৯২টি। পৌনে এক লাখের বেশি বিও হিসাব আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। শেয়ার শূন্য বিও বেড়েছে ৯০ হাজারেরও বেশি। ব্যালান্স শূন্য বিও হিসাব এখন তিন লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৩টি বলে সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশের (সিডিবিএল) হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে।
যা বলছেন বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা
বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘দীর্ঘদিন মন্দার কারণে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী এখন বড় লোকসানের মুখে। সালমানপন্থী একটি গ্রুপ বাজার বিক্রির চাপ তৈরি করে পতন ত্বরান্বিত করে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অস্থিরতার মধ্যে শেয়ার ছাড়ে। ’
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে কারসাজি বন্ধ করতে শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। নজরদারি জোরদার করতে হবে। পুঁজিবাজারে যতই সংস্কার করা হোক না, যাঁরা সংস্কারের দায়িত্বে থাকবেন তাঁদের সততা ও সাহসিকতা গুরুত্বপূর্ণ। ’