পৌষের মাঝামাঝিতে এসে ‘আসল রূপে’ আবির্ভূত হয়েছে শীতকাল। ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই সারাদেশে জেঁকে বসেছে শীত। হিমেল হাওয়া আর ঘন কুয়াশায় এতদিন উত্তরের জনপদ বিপর্যস্ত হলেও মাঝ পৌষে এসে গোটা দেশ কাঁপাচ্ছে শীত। এতদিন যারা হালকা গরম কাপড় গায়ে দিয়েছিলেন এখন তারা মোটা কাপড় পরছেন।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সকাল ১১টা পর্যন্ত রাজধানীর আকাশে দেখা যায়নি সূর্য। কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে চারপাশ। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শীতে গ্রামাঞ্চলে থাকা দরিদ্র মানুষের অবস্থা বেশি কাহিল।
বৃহস্পতিবার সকালে আবহাওয়া অধিদফতরের দেওয়া ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে দুপুর পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। এর ফলে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
তাপমাত্রা নিয়ে পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা ১ থেকে দুই ডিগ্রি হ্রাস পেতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে সারাদেশের কোথাও কোথাও দিবাভাগে শীতের অনুভূতি বিরাজ করতে পারে।
পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে দুপুর পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। এর ফলে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে। বর্ধিত পাঁচ দিনের পূর্বাভাসে শেষের দিকে তাপমাত্রা কমতে পারে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে।
চলতি মাসে ৩/৪ টি মাঝারি ও একাধিক তীব্র শৈত্যপ্রবাহের ইঙ্গিত দিয়ে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেছেন, জানুয়ারি বাংলাদেশের শীতলতম মাস। এ সময় তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। এ বছরও জানুয়ারিতে তাপমাত্রা কম থাকবে। হয়তো ২-৩টা মৃদু থেকে মাঝারি ও ১-২টা তীব্র শৈত্যপ্রবাহ চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশের উত্তরাঞ্চলের তাপমাত্রা ৪-৫ ডিগ্রিতেও নেমে যেতে পারে।
দেশজুড়ে জেঁকে বসা শীতের এমন প্রকোপ আরও কয়েকদিন চলতে পারে জানিয়ে বজলুর রশিদ বলেন, ‘উপরের দিকের ঠান্ডা বাতাস যখন নিচের দিকে নেমে আসে, তখন শীত বেশি অনুভূত হয়। এর বাইরে এবার কুয়াশাটা একটু বেশি। এই অবস্থা আগামী কয়েকদিন থাকতে পারে। এমন হলে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় শীত পড়বে বেশি।’
কুয়াশায় ঢাকা রাজধানী : ইংরেজি নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা। সকাল ১১টা পর্যন্ত দেখা মেলেনি সূর্যের। হিমেল বাতাসে অনুভূত হচ্ছে কনকনে শীত। দুপুর একটা পর্যন্ত বা আরও কিছু সময় পর পর্যন্ত এই অবস্থা বিরাজ করতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এ অবস্থায় বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলে পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।
পূর্বাভাসে আরও জানানো হয়, এদিন সকাল ছয়টায় ঢাকায় ১৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এসময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯১ শতাংশ। দুপুর পর্যন্ত পশ্চিম/উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ছয় থেকে ১২ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে যাবে।
কুয়াশার কারণে দৃশ্যমানতা কমে আসায় রাজধানীর অনেক এলাকায় হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে দেখা গেছে অনেক যানবাহনকে। অফিসগামী মানুষ এবং স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা ছিলেন শীতে জবুথবু। কুয়াশা ও শীতের তীব্রতা রাজধানীবাসীর জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে।
শীতে বিপর্যস্ত নওগাঁর জনজীবন : কনকনে ঠান্ডা আর হিমবাতাসে নওগাঁয় আবারও থমকে গেছে জনজীবন। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক কাজকর্ম। এতে নিদারুণ কষ্টে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় নওগাঁয় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এসময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১০০ শতাংশ।
স্থানীয়রা জানান, গত দুই দিন থেকে আবারও বেড়েছে শীতের দাপট। সকালে কুয়াশা কমলেও বেড়েছে ঠান্ডার দাপট। তাপমাত্রা কমার চেয়েও বেশি অসুবিধা হচ্ছে হিমশীতল বাতাসে। দিনের কিছুটা সময় সূর্যের দেখা মিললেও তা তেমন উত্তাপ ছড়াতে পারছে না। রাতদিন অনুভূত হচ্ছে শীত। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত অবস্থা বেশি ভয়াবহ থাকে।
গত কয়েকদিন ধরেই হঠাৎ শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার রাস্তাঘাটে শ্রমজীবী মানুষের দেখা মিললেও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম ছিল।
সদর উপজেলার বরুনকান্দি এলাকার রিকশা চালক লিটন বলেন, গত দুই থেকে আবার খুব শীত পড়েছে। এতো বাতাস হচ্ছে সবাইকে একেবারে কাবু করে ফেলেছে। এরমধ্যে গাড়ি চালানোই কষ্ট। যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না।
নওগাঁ বদলগাছী কৃষি ও আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আজ সকাল ৯টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে গতকাল তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকালের চেয়ে তাপমাত্রা কিছুটা কমেছে। হিমেল বাতাসের কারণেই কনকনে শীত অনুভূত হচ্ছে।
শীতে কাহিল পঞ্চগড়ের মানুষ : পঞ্চগড়ে তীব্র শীতের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উত্তর হিমালয় থেকে আসা হিমশীতল বাতাসের কারণে তাপমাত্রা ১০ থেকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেছে। কনকনে শীতের দাপটে গোটা অঞ্চলেই সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ছে। বিশেষত গত দুই দিন ধরে ঘন কুয়াশা আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে পঞ্চগড় এবং সূর্যের দেখা মিলছে না।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সকালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন বুধবার (১ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় তাপমাত্রা ছিল ১১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তেঁতুলিয়া প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত সহকারী কর্মকর্তা জিতেন্দ্র নাথ রায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
শীতের তীব্রতা বিশেষ করে শ্রমজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। শীত ও কুয়াশার কারণে বাইরে বেরিয়ে কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে তাদের জন্য। ঠান্ডা বাতাস এবং গরম কাপড়ের অভাবে মানুষ শীতে কষ্ট পাচ্ছে। দিনের বেলায়ও সূর্যের দেখা না মিললে শীতের তীব্রতা বাড়ছে। সন্ধ্যার পর থেকে ঘন কুয়াশায় রাস্তা ও লোকালয় ঢেকে যাচ্ছে, যা চলাচলে আরও সমস্যা তৈরি করছে। এছাড়া হিমেল বাতাসের কারণে মানুষের শরীর একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুরা অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছে।
মাইক্রোবাস চালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘন কুয়াশা আর হিম বাতাসের কারণে ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ভাড়া পেলেও কুয়াশার কারণে ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হয়, যা জ্বালানি তেল বেশি খরচ করে।
ভ্যানচালক জাফর আলী জানান, ভ্যানের হাতলে হাত রাখা যাচ্ছে না, হাত-পা সব নিঃস্তেজ হয়ে যায়। কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাসের কারণে রাস্তায় বেশিক্ষণ থাকাও সম্ভব হচ্ছে না। যাত্রীও মিলছে না। খুব কষ্টে একবেলা রিকশা চালাচ্ছি, ফলে রোজগার একেবারেই কমে গেছে।
শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার পরেও শীতবস্ত্র বিতরণে সরকারের তৎপরতা পর্যাপ্ত নয়, বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। শীতের কারণে হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগে শীতজনিত রোগীদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বিশেষত, শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, এবং যেসব রোগী বেশি অসুস্থ, তারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
কাঁপছে চুয়াডাঙ্গা : বছরের শুরুতেই শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়েছে চুয়াডাঙ্গা। বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সকাল ৬টায় চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গত ১৫ দিন ধরে তাপমাত্রা কিছুটা বেশি থাকলেও, নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন থেকেই শীতের প্রকোপ বেড়েছে। শৈত্যপ্রবাহের কারণে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষজনের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, ঠান্ডা বাতাস ও কুয়াশার কারণে সকাল থেকে রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা দেখা গেছে। শিশু ও বয়স্করা শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।