রবিবার, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫
রবিবার, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫

টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধহীন একটি মাস ও পরিসংখ্যান

হাবিবুল ইসলাম হাবিব:

টানা দু’বছরে দিনের পর দিন যেখানকার সকালটা যেত মৃত লাশের গন্ধে সেখানে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’র ঘটনা পুরোপুরি স্থবির। গতকাল ছিল ৩১ আগস্ট, এই মাসে বন্দুকযুদ্ধের নামে কোন হত্যাকান্ড ঘটেনি।

এদিকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার ঘটনার এক মাস পূর্ণ হলো। গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান।

এরপর থেকে এক মাস গড়ালেও মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে টেকনাফ, কক্সবাজারে কোন বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি। যদি প্রশাসনের হাতে উদ্ধার হয়েছে কোটি টাকার মাদকের চালান।

 

অন্যদিকে, সিনহা মামলার মূল আসামি লিয়াকতসহ চারজন এখন পর্যন্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও অন্য আসামিরা রয়েছেন র‌্যাবের রিমান্ডে। তবে মামলার সংশ্লিষ্টরা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির কথা জানান। আসামিদের কয়েক দফা রিমান্ডে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যাচাই বাছাইয়ের পরই দেয়া হবে চার্জশিট।

পরিসংখ্যান রেকর্ড অনুযায়ী, গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হন ২৮৭ জন। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ১৭৪, বিজিবির সঙ্গে ৬২ ও র‌্যাবের সঙ্গে ৫১ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। আর টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬১ জন। অবশ্য এমন অভিযানের পরও কমেনি মাদকের চোরাচালান।

 

পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানের নামে কথিত ক্রসফায়ারের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। এমন প্রশ্নের পর থেকে গত ৩০ দিনে মাদক উদ্ধারে গিয়ে বন্দুকযুদ্ধের একটি ঘটনাও ঘটেনি। কিন্তু উদ্ধার হয়েছে শত কোটি টাকা মূল্যের মাদকের চালান।

 

গত আগস্ট মাসে র‍্যাব-১৫ এর অভুযান নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজারের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মেহেদি হাসান বলেন, মাদকপাচারকারীরা ভেবেছিল সাগরে সিগন্যাল থাকায় সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা থাকবে না। তাই তারা বড় একটি চালান নিয়ে রওনা হয়েছিল। তবে সিগন্যাল থাকার পরেও আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাগরে অভিযান শুরু করি। মাদকবাহী নৌকাটি আটক করি। সেই নৌকা থেকে ১৩ লাখ পিস ইয়াবা করা উদ্ধার করা হয়।

 

এর একদিন আগে (২৩ আগস্ট) টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি) ২০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে এবং ২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা।

 

জানতে চাইলে টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্ণেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান বলেন, টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি) এর অধীনস্থ হোয়াইক্যং চেকপোস্টে তল্লাশি করে ইয়াবা জব্দ করা হয়। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সুযোগ নেই এখানে।

 

তার আগে (১৭ আগস্ট) কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন (৩৪ বিজিবি) ১ লাখ ৪০ হাজার পিস বার্মিজ ইয়াবা উদ্ধার করে বিজিবি। যাহার বাজার মূল্য প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ৩নং ঘুমধুম ইউপির দক্ষিণ রেজুআমতলী মসজিদের পার্শ্বে পাহাড়ের ঢালুতে সেখানে গুলি বিনিময়েরও ঘটনা ঘটে কিন্তু কোনো পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

 

এর আগে এই মাসেই টেকনাফে অভিযান চালিয়ে ১ জন আসামিসহ ৪ কোটি টাকা মূল্যের ১ লাখ ৪০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে বিজিবি।

 

বিজিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের দুর্গম পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা চোরাচালান বেড়েছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সময়ে বাহিনীটি একাধিক অভিযান চালিয়ে ১৫ লাখের বেশি ইয়াবা বড়িসহ ৯৯ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১২ ইয়াবা কারবারি।

 

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্ণেল আশিল বিল্লাহ বলেন, র‍্যাবের যে বর্ণাঢ্য ইতিহাস সেই ইতিহাসে কখনোই বন্দুকযুদ্ধ হয়নি। যা হয়েছে তা হলো অপরাধীদের ধরতে গিয়ে বিভিন্ন সময় বিরুপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। র‍্যাব যে ধরনের অপারেশন করে থাকে সে ধরনের অপারেশন একটি কোয়ালিটিফুল বা গুণগত মানের অপারেশন। এটার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের কোনও সম্পর্ক নেই। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ছাড়ায় র‍্যাব সফলতা দেখিয়েছে।

 

তিনি বলেন, কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে যে ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে র‍্যাব সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও র‍্যাব তার আভিযানিক কার্যক্রম চলমান রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে শুধু ১৩ লাখ পিস ইয়ায়াবাই নয় টেকনাফ ছাড়াও সারাদেশেই আভিযানিক কার্যক্রম চলমান আছে।

 

বন্দুকযুদ্ধের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, গত এক মাসে কক্সবাজারে ক্রসফায়ার নেই এটা একদিক থেকে ভালো। কারণ যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতো তাদের বোধদয় হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যা করা যায় না। এটা জনগণ এখন বুঝে গেছে, সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে, কোর্টও আকৃষ্ট হয়েছে। সিনহা সাহেবের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরও বেশি করে হয়েছে।

 

তিনি বলেন, এর আগেও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে কিন্তু মাদক বন্ধ হয়নি। তবে সিনহা হত্যার এক মাসের মধ্যে যেহেতু ক্রসফায়ারে ঘটনা ঘটেনি তাহলে ধরে নিতে হবে যতগুলো ক্রসফায়ার হয়েছে তার একটাও ঠিক ছিল না। যদি ঠিক থাকতো তাহলে গত এক মাস কেন বন্ধ।

 

এই মানবাধিকারকর্মী আরও বলেন, ওসি প্রদীপ, লিয়াকত ও এর সঙ্গে আরও যারা জড়িত তাদের সবাইকে দৃষ্টিতে নিয়ে এসে যদি রাষ্ট্র আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে আমার মনে হয় রাষ্ট্র আরও সম্মানজনক পর্যায়ে যাবে সঙ্গে আইনশৃংখলা বাহিনীরও সম্মানজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে।

Similar Articles

Advertismentspot_img

Most Popular