২৩ নভেম্বর ২০১৯ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, সময়ের হিসেবে কেটে গেছে ১০২০ দিন। এই হাজার বিশ দিনে অতিমানব বিরাট কোহলি নেমে এসেছিলেন নেহায়েত মানুষের কাতারে, যিনি আমাদের মতোই ভুল করেন, দুঃখে যার মাথা এলোমেলো হয়, যাকে বিষণ্ণতা আঁকড়ে ধরে। এ থেকে নিস্তার পেতে ভজন শুনতে গিয়েছিলেন, নিয়েছিলেন ব্যাট ধরা থেকে ১ মাসের একটা বড় বিরতিও।
সেসব যেন একটা বড় উপকারই করল তার। এশিয়া কাপের শুরু থেকেই তার ব্যাটে ছিল দুঃসময় পেছনে ফেলার সুর। শুধু সেঞ্চুরির সুযোগটাই আসছিল না। অবশেষে সে সুযোগটা এল, ওপেনার হিসেবে নামার পর। সে সুযোগটাই তিনি লুফে নিলেন দুই হাতে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে পেলেন প্রথম টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরির দেখা। তাতে পেছনে ফেলে দিলেন ১০২০টি সেঞ্চুরিহীন দিনও! তার অপরাজিত সেঞ্চুরিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ভারত পেয়ে গেছে ২১২ রানের বিশাল পুঁজিও।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ভারতের ম্যাচটার মূল্য আগেই ‘নেই’ করে দিয়েছিল এশিয়া কাপের দশম ম্যাচটা। নাসিম শাহর দুই ছক্কায় পাকিস্তান চলে গিয়েছিল ফাইনালে, সঙ্গে শ্রীলঙ্কাও; আফগানিস্তান আর ভারতের বিদায়ঘণ্টাও বেজে গিয়েছিল তাতে। ফলে আজকের ম্যাচটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নেহায়েত নিয়ম রক্ষার।
প্রেক্ষাপটটা মিলে যাচ্ছিল অঞ্জন দত্তের লেখা এক গানের সঙ্গে। ‘জোন অফ আর্ক’ গানে তিনি লিখেছিলেন, ‘জেতা হারার প্রশ্ন আজ আর বড় নয়, শুধু হতে পারো অন্যরকম!’ ভারতের সামনে ছিল সেই অন্যরকম হওয়ার সুযোগ। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক লোকেশ রাহুল তাই টসের সময় এসে টস জিতে ফিল্ডিং করার ‘রেওয়াজ’ ভাঙতে চান। নিতে চান ব্যাটিং, শেষে ফিল্ডিং করলে টানা তিন হারের শঙ্কা আছে জেনেও!
অধিনায়ক রাহুলকে অবশ্য সেই ‘অন্যরকম’ হতে দেয়নি ভাগ্য; বিশ্রামের কারণে নেই যিনি, সেই রোহিত শর্মার মতো তিনিও হারেন টসে। আফগান অধিনায়ক মোহাম্মদ নবী টস জিতে ভারতকে পাঠান ব্যাটিংয়ে।
তবে কোহলি ঠিকই ‘অন্যরকম’ হয়েছেন ভিন্ন ভূমিকায় নেমে। এতদিন মাঠে আসতেন তিনে, ম্যাচের মেজাজ বুঝে। আজ রোহিতের অনুপস্থিতিতে নামতে হলো শুরুতেই। থিতু হওয়ার সময় পেলেন একটু বেশি। তার ফলটাও মিলল হাতেনাতেই। পাওয়ারপ্লের প্রথম ৫ ওভারে ১০০ স্ট্রাইক রেটে খেলা কোহলি গিয়ারটা বদলালেন ষষ্ঠ ওভারে এসে, মুজিব উর রহমানের এক ওভারে এক ছক্কা, দুই চারে ১৫ রান তুলে। ফিফটিটা তুলে নিয়েছিলেন ৩২ বলে।
থিতু হয়ে গিয়েছিলেন, বোঝাই যাচ্ছিল; সময়টাও দেদার ছিল তার সামনে। তবে এমন কত সুযোগ শেষ ১০২০ দিনে পায়ে ঠেলেছেন তিনি, তার ইয়ত্তা নেই! তার ওপর ১৩তম ওভারে তিন বলের ব্যবধানে দুই সঙ্গী রাহুল আর সূর্যকুমার যাদবকে হারিয়ে বসেছিলেন, যা কোহলির মনোযোগ নাড়িয়ে দিতেই পারত; তা না হলেও অন্তত খোলসে তো ঢুকে যেতেই পারতেন!
কোহলি আজ তা করেননি। বরং ফুঁসে উঠলেন দ্বিগুণ রাগে। প্রথম ফিফটির দেখা পেতে যেখানে খেলে ফেলেছিলেন ৩২ বল, সেখানে পরের ৫০ ছুঁতে তিনি বল খেললেন মোটে ২১টা। ১৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে তার সোনালি সময় মনে করিয়ে দেওয়া এক পুল শটেই পেলেন পরম আরাধ্য সেঞ্চুরির দেখাটা। ডিপ মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কায় ১০২০ দিন পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন অঙ্ক ছুঁলো তার ইনিংস। ক্যারিয়ারের স্বর্ণসময়ে যে ফরম্যাটে পাননি সেঞ্চুরির দেখা, সেই ফরম্যাটেই পেলেন আক্ষেপ ঘোচানো শতকটা।
কোহলি তার উদযাপন দিয়েও ‘অন্যরকম’ হলেন আজ। এমনিতেই সেঞ্চুরির স্মৃতিগুলোয় ধুলো জমেছে। সেগুলো হাতড়ে ফিরলে আপনার মনে পড়তে পারে একেকটা সেঞ্চুরির পর তার বাঁধনহারা উল্লাসের কথা। সেসবের বালাই ছিল না আজকের উল্লাসে, তিন অঙ্ক ছুঁয়ে এগিয়ে গেলেন সতীর্থ ঋষভ পান্তের কাছে, জড়িয়ে ধরলেন। হেলমেট খুলে, ব্যাট উঁচিয়ে একটা স্বস্তির হাসি… এই তো!
কোহলি সেঞ্চুরি করেই দমে গেলেন না। টিকে রইলেন শেষতক, ২০০ স্ট্রাইক রেটে ১২২ রানের ইনিংস খেলে লড়াইটা শেষ করে তবেই ফিরলেন। তাতে এশিয়া কাপের আপাতদৃষ্টিতে ‘অর্থহীন’ ম্যাচটায় ভারত পেল ২১২ রানের পুঁজি। এশিয়া কাপের ফর্মটা, এই সেঞ্চুরির ছন্দটা যদি কোহলি টেনে নিয়ে যেতে পারেন বিশ্বকাপ পর্যন্ত, তাহলে হয়তো আর এই ম্যাচ অতটা ‘অর্থহীন’ থাকবে না ভারতের জন্য! এই ম্যাচ দিয়েই যে ১০২০ দিনের আক্ষেপের ইতি টেনেছিলেন কোহলি!