জাহিদুর রহমান তারিক,ঝিনাইদহঃ শীতের শুরুতে ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন গ্রামের গাছিরা এখন খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিভিন্ন গ্রামে ইতোমধ্যে গাছ তোলার কাজ শেষ হয়েছে। নলেন গুড় ও পাটালি বাজারে উঠতে শুরু করেছে। আগাম গুড় ও পাটালিতে দাম ভালো পাওয়া যায় বলে এলাকায় পাটালি গুড় তৈরির ধুম পড়ে গেছে। ঝিনাইদহ সদর, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর, হরিণাকুন্ডু ও শৈলকুপা উপজেলায় প্রচুর সংখ্যক খেজুর গাছ লক্ষণীয়। এসব এলাকায় প্রতিটি বাড়িতে, জমির আইলে, রাস্তার পাশে, পতিত জমিতে সারি সারি খেজুর গাছ দেখা যায়। বর্তমানে এসব এলাকায় বাণিজ্যিক ভাবেও খেজুর বাগান গড়ে তুলছেন অনেকে। শীতের সাথে খেজুর রসের রয়েছে এক অপূর্ব যোগাযোগ। শীত যত বাড়তে থাকে খেঁজুর রসের মিষ্টতাও তত বাড়ে। এ সময় গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতিক মধুবৃক্ষ থেকে সু-মধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে পুরোদমে শুরু হয় পিঠা, পায়েস ও গুড় পাটালী তৈরির ধুম। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা নলের গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় ও পাটালি গুড়ের মিষ্টি গন্ধেই যেন অর্ধভোজন হয়ে যায়। খেজুর রসের পায়েস, রসে ভেজানো পিঠাসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারেরতো জুড়িই নেই। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাগান্না গ্রামের গাছি হায়দার আলী জানান, তার প্রায় দেড়শ খেজুর গাছ রয়েছে। শীত মৌসুমে এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় ও পাটালি তৈরি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপারীরা এসে এসব গুড় পাটালি কিনে নিয়ে যায়। দামও বেশ ভালো পাওয়া যায়। গত বছর তিনি ১০ কেজি ওজনের এক কলস গুড় ৭০০ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এবছরও ভালো দাম পাওয়ার আশা করছেন তিনি। ঝিনাইদহের সিমান্ত জীবনা গ্রামের আতিয়ার রহমানের ছেলে মিলন মিয়া বলেন, খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় ও পাটালি তৈরি করে স্থানীয় বদরগঞ্জ বাজার দশমাইলে বিক্রি করেন। গত বছরের তুলনায় এবার খেজুর গুড় ও পাটালির দাম একটু বেশিই পাচ্ছেন বলে জানান। কুতুবপুর গ্রামের গাছি আবদুর রসিদ জানান, এ বছর তিনি ৫০টি খেজুর গাছ কেটেছেন। এক সপ্তাহ পর থেকেই গাছ থেকে রস পাওয়া যাবে। গত বছর তিনি খেজুরের গুড় ও পাটালি বিক্রি করে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা লাভ করেন।
চলতি বছর আরও বেশি দামে গুড় বিক্রির আশা করছেন তিনি। কোরাপাড়ার ওলিয়ার রহমান জানান, গত বছর ১০ কেজি ওজনের এক কলস গুড় উৎপাদন করতে খরচ হয়েছিল ৪০০ টাকা। আর বিক্রি করেছেন ৭০০ টাকায়। তিনি জানান, জ¦ালানিসহ সব ধরনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবছর লাভের পরিমাণ কমে যেতে পারে। তবে দাম ভালো পাওয়া গেলে তা পুষিয়েও যাবে। সরেজমিনে গিয়ে সদর উপজেলার রাজনগর, কাশিপুরসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, ভোরে গাছিরা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বাড়িতে আনছেন। পরিবারের সবাই রস জালানো, কলস পরিষ্কার করাসহ নানা কাজে সহযোগিতা করছেন। আবার দুপুরেই গাছিরা দা, হাসুয়া, ঠুঙি, দড়ি ও মাটির কলস (ভাড়) নিয়ে ছুটে চলেছেন মাঠে। ঝিনাইদহ কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ঝিনাইদহে প্রায় তিন লাখের মত খেজুর গাছ রয়েছে। এর মধ্যে সদরের ১৭টি ইউনিয়নেই রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি গাছ। তবে সঠিকভাবে পরিচর্যা না করা ও এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ির কারণে খেজুর গাছ আজ বিলপ্তির পথে। ইটভাটা গুলোতে খেজুর গাছ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ভাঁটা মালিকরা নির্বিচারে খেজুর গাছ দিয়ে ইট পুড়িয়ে যাচ্ছে। ইট ভাটায় জ¦ালানি হিসেবে খেজুর গাছ ব্যবহার করার কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে দ্রুত খেজুর গাছ ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝিনাইদহসহ পার্শ্ববর্তী জেলা গুলোতে কিছুকিছু এলাকায় এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণ খেজুর গাছ থাকলেও সঠিকভাবে তা পরিচর্যা না করা, নতুন করে গাছের চারা রোপণ না করা এবং গাছ কাটার পদ্ধতিগত ভুলের কারণে প্রতি বছর অসংখ্য খেজুর গাছ মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া এক শ্রেনীর অসাধু ইটভাটার ব্যবসায়ীরা জ¦ালানি হিসেবে খেজুর গাছ ব্যবহার করার কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা। ঝিনাইদহ পরিবেশ ও জীববৈচিত্য সংরক্ষণ কমিটির সদস্য সচিব মো. মিজানুর রহমান জানান, ইট ভাঁটা গুলোতে কাঠ পোড়ানোর কারণে সার্বিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সাথে এলাকা থেকে খেজুর গাছও উজাড় হচ্ছে। খেজুর গাছসহ সকল প্রকার বৃক্ষ নিধন বন্ধ এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্য সংরক্ষণে সবাইকে গাছ লাগানোর আহ্বান জানান তিনি।