আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। রাজনীতির ‘মুরব্বি’ হিসেবে পরিচিত ১৪ দলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আমুর দাপট এমন পর্যায়ে ছিল যে, তার মতের বাইরে গিয়ে কিছু বলা বা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। এলাকার অনেকের চোখে মহাগডফাদার সাবেক এই মন্ত্রী। কৃষিজমি আর বাড়ি ভাড়া থেকেই আয় হতো তার।
তবে নেপথ্যে আয়ের মূল উৎস ছিল চাকরির তদবির, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, কমিটি গঠন, নির্বাচনী মনোনয়ন-বাণিজ্য। এই খাত থেকে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ নিতেন নগদে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। এরপর আমুর ঝালকাঠির বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে।
তাঁর বাড়ি থেকে পোড়া-অক্ষত মিলিয়ে প্রায় চার কোটি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ।
আমুর ভায়রাভাই ফখরুল মজিদ কিরণ। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ছোট ভাই তিনি। বাড়ি নরসিংদী জেলায়। নিজের এলাকা নরসিংদী হলেও পড়ে থাকতেন ঝালকাঠিতে। শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে আমির হোসেন আমুর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ছিলেন কিরণ।
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় ১৬ বছরে আমুর হয়ে জেলার সব ধরনের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগবাণিজ্য, কমিটি গঠন, নির্বাচনী মনোনয়ন বিক্রি করতেন কিরণ। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সব টাকাই দিতেন আমুকে। কিরণের নেতৃত্বে ঝালকাঠিতে ‘চার খলিফা’র উত্থান ঘটেছিল। আর তাদের মাধ্যমে আমু হয়ে উঠেছিলেন মহাগডফাদার।
কিরণের পাশাপাশি ‘চার খলিফা’ দলীয় মনোনয়ন ও কমিটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে নলছিটি উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমুর সঙ্গে দেখা করতে হলে অনুমতি নিতে হতো কিরণের। উন্নয়নমূলক সব কাজের ভাগ-বাটোয়ারা করতেন তিনি। শুধু সম্পদ ভাণ্ডারের দেখাশোনা আর পার্সেন্টেজ আদায় নয়, তার কথার বাইরে এক পা-ও চলতেন না আমু। পরিস্থিতি এমন ছিল যে আমুর ছায়া ছিলেন কিরণ।
আমির হোসেন আমুর কোনো সন্তান ছিল না। আমুর শ্যালিকা মেরী আক্তার ও কিরণ দম্পতির মেয়ে সুমাইয়া হোসেন। নিঃসন্তান আমু অনেক বছর আগে সুমাইয়াকে দত্তক নিয়েছিলেন।
আমুর মেয়ে সুমাইয়া আর কিরণের কাছেই অবৈধ আয়ের অধিকাংশ গচ্ছিত ছিল, যার প্রায় পুরোটাই এখন দুবাইপ্রবাসী তার মেয়ে সুমাইয়ার কাছে আছে বলে ধারণা সবার। সেখানে হুন্ডিসহ নানা উপায়ে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন আমু। সেই অভিযোগের আলোকে দুদক প্রাক-তদন্ত শুরু করেছে।
আমির হোসেন আমু ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা দখল করে তাঁর মা-বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আকলিমা মোয়াজ্জেম হোসেন ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রায় ছয় একর জমি জোর করে নামমাত্র মূল্যে লিখে নেন তিনি।
আকলিমা মোয়াজ্জেম হোসেন ডিগ্রি কলেজের পাশে ঝালকাঠি শহরের বিশিষ্ট লবণ ব্যবসায়ী ফজলুল হক হাওলাদারের ৩৬ শতাংশ জমি ছিল। সেই জমির ওপর আমুর নজর পড়ে। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজের জন্য সেই জমি লিখে দিতে চাপ সৃষ্টি করেন।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ফজলুল হক বলেন, ‘আমার পরিবারের এক একর ১১ শতাংশ জমি জোর করে নিয়ে যায় আমির হোসেন আমু। আমার ব্যবসায়ী অংশীদার সালেক শরীফের সঙ্গে একটি লবণের মিল নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। মীমাংসার নামে আমির হোসেন আমু পুরো মিলের মালিকানা সালেক শরীফকে দিয়ে দেন। আমার পক্ষে কথা বলবে বলে আমু আমার কাছ থেকে নগদ পাঁচ লাখ টাকা নেন। আমু ভাইয়ের ঢাকার ইস্কাটনের বাসায় গিয়ে আমার স্ত্রী কিছু দিন কাজ করেছেন, যাতে জমিটি লিখে দিতে না হয়। কিন্তু তাতেও আমুর মন গলেনি। এক পর্যায়ে মাত্র আট লাখ টাকার বিনিময়ে বাড়িসহ ছয় শতাংশ জমি লিখে দিতে বাধ্য হই।’
একইভাবে আমির হোসেন আমু তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজের জন্য আবদুর রাজ্জাক, পাদুকা ব্যবাসায়ী সম্রাট সু হাউসের মালিক নির্মল বাবু, সাবিহা কেমিক্যাল ওয়ার্কসের মালিক মো. সামসুল হক মনু ও তাঁর ভাই-বোনদের ৩৬ শতাংশসহ অনেকের জমি দখল করে নেন।
কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতার কারণে সেখানে আর সেই প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণ করা হয়নি। পরে সেখানে ২০২৩ সালে বেগম ফিরোজা আমির হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নামে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়।
এ বিষয়ে বেগম ফিরোজা আমু ঝালকাঠি টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি ও ঝালকাঠির সাবেক পৌর মেয়র লিয়াকত আলী তালুকদার বলেন, ‘কলেজের ভবন নির্মাণের জন্য যে জমির প্রয়োজনে সমঝোতার মাধ্যমে একটু জমি নিয়েছি। পরবর্তী সময়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন খান সুরুজ ওরফে রাঙ্গা ভাই, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজ আল মাহমুদ, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রেজাউল করিম জাকির ওরফে জি এস জাকির, যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল শরীফ। এদের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে আমু পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন আদায় করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তাদের দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ চার খলিফা হিসেবে চিনত। আমুর ভায়রা ও একান্ত সচিব ফকরুল মজিদ কিরণ উন্নয়নকাজের কমিশনের একটি ভাগ পেতেন। এ ছাড়া ঢাকার ইস্কাটনের বাসার আমুর ব্যক্তিগত সহকারী শাওন খানকেও কিছু ভাগ দিতে হতো। আমুর জন্য কমিশন আদায় করতে গিয়ে তাঁরা নিজেরাও শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। আমির হোসেন আমুর নাম ভাঙিয়ে ৩০-৪০ পার্সেন্টে (কমিশন) সাধারণ ঠিকাদারদের কাছে কাজ বিক্রি করে দিতেন। এর মধ্যে এলজিইডি, সড়ক বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের অফিস খরচসহ আমুর কমিশন রেখে তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করতেন।
আমুকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত করা হলে তার জন্য প্রায় ৫০ পদের খাবারের আয়োজন করতে হতো। এতে লাখ টাকার বাজেট করতে হতো।
আমু যখন শিল্পমন্ত্রী ছিলেন, তখন অনুষ্ঠানের আয়োজকদের তাঁকে সোনার নৌকা উপহার দিতে হতো। একবার তাঁকে উপহার হিসেবে সোনার নৌকা দেওয়া হয়।
তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনের রাজনীতিতেও। তার প্রভাবে জেলার প্রতিটি সাংগঠনিক কমিটিতে সভাপতি-সম্পাদকসহ তাঁর মনোনীত ব্যক্তিরা স্থান পেয়েছেন। দলের ত্যাগীরা অবহেলার শিকার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিএনপিপন্থী ব্যক্তিদের দলের বড় পদে বসানোর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ব্যবসায়ীদের সংগঠন জেলা চেম্বার অব কমার্স, জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, শিল্পকলা এলাকডেমিসহ বিভিন্ন কমিটিতেও পদ পেতে আমুকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো।