নিউজ ডেস্ক:
জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে খুব শিগগির অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ পাঠানো হচ্ছে। দাম সমন্বয়ের পরেও জ্বালানি তেল বিক্রি করে বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মুনাফা হবে প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি তেলের দাম কমতে কমতে বর্তমানে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশে গত বছর জ্বালানি তেলের দাম এক দফা কমানো হলেও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ অবস্থায় অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরো সমন্বয় করা প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজনের তাগিদে জ্বালানি তেলের দাম কমাতে যাচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের জন্য একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সারসংক্ষেপে পেট্রোল ও অকটেনে ৫ শতাংশ এবং কেরোসিন ও ডিজেলে ৮ শতাংশ দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে পেট্রোলের দাম হবে ৮১ টাকা ৭০ পয়সা, অকটেনের দাম হবে ৮৪ টাকা ৫৫ পয়সা এবং কেরোসিন ও ডিজেলের দাম হবে ৬০ টাকা। এ চার পণ্যে দাম কমানো হলেও আপাতত জেট-এ-১ এবং ফার্নেস ওয়েলের দাম অপরিবর্তিত থাকবে।
চলতি সপ্তাহেই দাম কমানোর একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ প্রস্তাব অনুমোদন পেলে, বিশেষ করে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমালে/সমন্বয় করলে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও গ্রামাঞ্চলের মানুষরা বেশি উপকৃত হবেন। ডিজেলের দাম কমলে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ভর্তুকি কমবে। পাশাপাশি কৃষক ও বিদ্যুৎচালিত পাম্প ব্যবহারকারীরাও বিশেষ সুফল পাবেন।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ব্যাপারে কাজ চলছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করেই সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।’
সূত্র জানায়, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপে পেট্রোলের দাম ৪ টাকা ৩০ পয়সা, অকটেনের ৪ টাকা ৪৫ পয়সা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের বাজারে বর্তমানে পেট্রোলের খুচরা মূল্য ৮৬ টাকা। ৪ টাকা ৩০ পয়সা কমালে পেট্রোলের দাম হবে ৮১ টাকা ৭০ পয়সা। অকটেন বিক্রি হচ্ছে ৮৯ টাকায়। ৪ টাকা ৪৫ পয়সা কমালে এটির মূল্য হবে ৮৪ টাকা ৫৫ পয়সা। একইভাবে কেরোসিন ও ডিজেলে ৫ টাকা করে কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে এ দুটি জ্বালানি ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ৫ টাকা করে কমালে এ দুটির দাম হবে ৬০ টাকা করে।
সূত্র জানায়, এ চার ধরনের তেলের দাম কমানো হলেও বিপিসি প্রতিটিতেই লাভ করবে। পেট্রোলে লাভ হবে ১১৬ কোটি টাকা। অকটেনে লাভ হবে ১২৫ কোটি টাকা। কেরোসিনে লাভ হবে ৩৩৫ কোটি টাকা। আর ডিজেলে লাভ হবে ১ হাজার ২৭৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ দাম কমানোর পরও এ চার জ্বালানি তেলে বিপিসি বছরে ১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা লাভ করবে। আগামী দিনে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কেমন থাকবে তা বিশ্লেষণ করে এ প্রস্তাবগুলো করা হয়েছে বলে সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে।
সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ব্লুমবার্গ নিউজ অনুযায়ী, গত তিন বছরে জ্বালানি তেলের মূল্যপতন হলেও বিশষজ্ঞদের মতে, ২০১৭ সালে এটি কিছুটা স্থিতিশীল থাকবে। এক্ষেত্রে জ্বালানি তেল (বিশেষত ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল) বিক্রি হবে ব্যারেল প্রতি ৫৮ মার্কিন ডলারে। ব্লুমবার্গের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর সময়ে গড়ে প্রতি ব্যারেল ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ৫৪ দশমিক ৩৩ মার্কিন ডলার। সে হিসেবে ২০১৭ সালে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি গড়ে ৫৬ মার্কিন ডলার দাম হবে বলে ধারণা করা যায়।
সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে- সৌদি আরব, রাশিয়া, মেক্সিকো, আজারবাইজানসহ আরো কিছু তেল উৎপাদনকারী দেশ তেল উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। চাহিদার তুলনায় যাতে সরবরাহ বেশি না হয় সেজন্যই দেশগুলো এ কৌশল অবলম্বন করছে। সৌদি আরব প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৬০ থেকে ৭০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু গালফ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, চলতি বছর তেলের ব্যারেল প্রতি দাম ৬০ মার্কিন ডলারের মধ্যেই ওঠা-নামা করবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি বছর ব্যারেল প্রতি দাম দাঁড়াবে ৫৫ দশমিক ২ মার্কিন ডলার। এগুলো থেকে ধরে নেওয়া যায়, চলতি বছর ব্যারেল প্রতি জ্বালানি তেলের দাম ৬০ মার্কিন ডলারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ৬০ মার্কিন ডলার বিবেচনায় হিসেব করলে(৮ শতাংশ কমালে) ডিজেলে লাভ থাকবে ৩ টাকা ২২ পয়সা। কেরোসিনের দাম ৬০ টাকা ধরলে লাভ হবে ১০ টাকা ৫৬ পয়সা।
বর্তমানে সর্বোচ্চ ব্যবহৃত জ্বালানি তেল হলো ডিজেল। বর্তমানে ডিজেল ব্যবহার করা হয় ৬৪ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল ১৭ শতাংশ এবং কেরোসিন ব্যবহার করা হয় ৫ শতাংশ। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমালে/সমন্বয় করা হলে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত কিংবা গ্রামাঞ্চলের মানুষই বেশি উপকার পাবেন।
ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি), রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট (আরপিপি) এবং কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে (কিউআরপিপি) ডিজেল ব্যবহার করা হয়। ডিজেল চালিত প্ল্যান্টেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। ডিজেলের দাম কমালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকি কমবে।
জ্বালানি তেলের দাম কমানো/সমন্বয় করা হলে অর্থনীতিতে এবং সাধারণ জনগণের ওপর কী প্রভাব পড়বে তার একটি বিবরণ সারসংক্ষেপে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হলে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। জনগণও এর সুফল পায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক সমীক্ষায় প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫৫ থেকে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে, রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ দশমিক ৩৯ থেকে ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বেসরকারি বিনিয়োগ ২২ দশমিক শূণ্য ৭ থেকে ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেড়েছে।
২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কমেছে প্রায় ৭ থেকে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সরকার আবারো জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করলে বা কমালে এসব খাতসহ অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও সুফল পাওয়া যাবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সারসংক্ষেপটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী এটিতে অনুমোদন দিলে তা কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।