বিশ্ব প্রবীণ দিবস আজ। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস-২০২৪’ উদযাপিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য: বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’।
প্রতিটি মানুষের জীবনে জরা বা বার্ধক্য এক চরম সত্য। শৈশবের সোনালি সকাল শেষ করে, তারুণ্য আর যৌবনের রোদেলা দুপুর পাড়ি দিয়ে, মাঝ বয়সের ব্যস্ত বিকালটাও যখন চলে যায়, তখনই জীবনসায়াহ্নের গোধূলিবেলা জুড়ে আসে বার্ধক্য। বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অবহেলার শিকার এখন অসহায় প্রবীণরাই, কিন্তু ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের অসহায়ত্ব মোকাবিলা করার মতো দরকারি প্রস্তুতি আমাদের নেই। অরক্ষিত এই প্রবীণদের সেবা দেয়ার জন্য যে নতুন ব্যবস্থা প্রয়োজন তা গড়ে উঠছে না। অসহায় প্রবীণদের কল্যাণে এখনই আমাদের উদ্যোগী হওয়া জরুরি। কেননা বার্ধক্য হচ্ছে প্রতিটি মানুষের অবধারিত সমস্যা। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ।
তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে। আর এখন থেকেই নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে। দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া-পাওয়া সমাধান করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার গণসচেতনতা, আর এই গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের অবহেলা, অযত্ন, দুর্ব্যবহার, নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো সব শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান প্রদর্শন করা হবে।
মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১০ কোটিতে। ২০৩০ সালে এর সংখ্যা হবে ১৫০ কোটি এবং ২০৫০ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ২০২৫ সালে প্রবীণদের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটিতে। ২০৫০ সালে প্রবীণ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার কোটিতে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৬০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অপ্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় প্রবীণদের সংখ্যা বেশি হবে।
এক বেসরকারি জরিপে জানা গেছে, বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবনযাপন করছেন। যে প্রবীণ যৌবনে তার মেধা, মনন, দক্ষতা দিয়ে সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন, মানব কল্যাণে অবদান রেখেছেন, বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষটি অযত্ন, অবহেলার আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। আমাদের দেশে বৃদ্ধ পিতামাতা কত যে অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করছেন বাইরে থেকে সেটা বোঝা যায় না। অনেক সময় বৃদ্ধ পিতামাতার সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করা, চিকিৎসা না করানো, বৃদ্ধ পিতামাতাকে আলাদা রাখা, এমনকি শেষ সম্বল পেনশনের টাকা, জমি-জায়গা বাড়িটুকু পর্যন্তও জোর করে লিখে নেয়া হচ্ছে। অনেক মা-বাবা মাদকাসক্ত ছেলেমেয়ের কাছ থেকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বা সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায় না। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও সুন্দর জীবন গড়ার জন্য পিতামাতা ও সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, অনুরূপভাবে প্রবীণদের কষ্ট লাঘবের জন্য সন্তান, সমাজ ও সরকারের দায়িত্ব নেওয়া একান্ত জরুরি।
এক্ষেত্রে প্রত্যেক উপজেলা শহরে প্রবীণদের জন্য হাসপাতাল গড়ে তুলে বিনা খরচে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রত্যেক হাসপাতালে প্রবীণদের জন্য আলাদা ইউনিট চালু করতে হবে। চলাফেরার ক্ষেত্রে বাস, ট্রেন ও আকাশপথে অর্ধেক ভাড়ায় সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সব প্রবীণের জন্য প্রবীণ ভাতা চালু করতে হবে। সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রবীণদের যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলোর সমাধান না করলে প্রত্যেককেই বৃদ্ধ বয়সে এ অবহেলা ও কষ্টের স্বাদ নিতে হবে।
আমাদের দেশে অনেক সন্তানের মা-বাবা পরিচর্যা করার ইচ্ছা থাকলেও তাদের কর্মব্যস্ততার কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করে মা-বাবার পরিচর্যা বা সেবা যত্ন করতে পারে না। অনেক মা-বাবা নিজের ভিটামাটি ছেড়ে বিদেশে সন্তানের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে না। এসব নানা কারণে দিন দিন সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার সুসম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া অনেক মা-বাবার পুত্রসন্তান না থাকায় জামাই-মেয়ের বাড়িতে থাকতে পছন্দ করেন না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই উপায়- কষ্টের বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রত্যেক উপজেলায় আনন্দের সঙ্গে বসবাস করার জন্য ‘আনন্দ আশ্রয়’ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে একই বয়সের অনেকেই থাকার কারণে প্রবীণরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে স্বেচ্ছায় থাকতে চাইবেন।
প্রবীণদের ভালো রাখার জন্য প্রত্যেক উপজেলার শহরের কাছাকাছি কমপক্ষে পাঁচ একর জমির ওপরে ‘আনন্দ আশ্রয়’ গড়ে তুলতে হবে। আনন্দ আশ্রয়ে থাকবে প্রবীণদের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, থাকবে ভালো নার্সিং ব্যবস্থা, থাকবে ভালো মানের খাবার, বিনোদনের ব্যবস্থা, থাকবে প্রার্থনার জন্য মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি। থাকবে ভালো আবাসনের ব্যবস্থা। এখানে যে কোনো প্রবীণ স্ব-ইচ্ছায় থাকতে পারবেন। যাদের দেখার কেউ নেই, তাদের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বা একা থাকার ব্যবস্থা রাখতে হবে। ধনী প্রবীণরা ভাড়া বা খরচ দিয়ে থাকতে পারবেন। প্রয়োজন হলে তারা স্ব-ইচ্ছায় কিছুদিন নিজের বাড়িতে, কিছুদিন ‘আনন্দ আশ্রয়ে’ থাকতে পারবে। একই বয়সের অনেকে এক সঙ্গে থাকার কারণে প্রবীণরা আনন্দে থাকবে। এতে সন্তান, আপনজনরা দেশে-বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন মা-বাবা ভালো আছেন ভেবে তারাও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। প্রয়োজনে সন্তান, আপনজন বিদেশ থেকে এসে কিছুদিন আনন্দ আশ্রয়ে মা-বাবাকে সঙ্গ দিতে পারবেন। গরিব অসহায় প্রবীণদের সরকারি খরচে থাকার ব্যবস্থা থাকবে। প্রবীণ বা বয়স্ক ব্যক্তিরা সম্মানিত। তারা দ্বিতীয় শিশু। আমাদের মনে রাখা উচিত, আজ যারা প্রবীণ তারাও অতীতে তার পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণে অনেক অবদান রেখেছেন। প্রবীণরা যেন অবহেলিত, উপেক্ষিত, সমাজে ও পরিবারে অনেকের কাছে বোঝা স্বরূপ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সবার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া অবশ্য কর্তব্য।
অসহায় প্রবীণদের বিষয়টি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে, জনসচেতনতা ও প্রচারের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘আনন্দ আশ্রয়’ গড়ে তোলার জন্য নিজ দায়িত্বে সবাই এগিয়ে এলেই সত্বর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে এ মহৎ উদ্যোগকে বেশিরভাগ সচেতন মানুষ ও ভুক্তভোগী প্রবীণরা স্বাগত জানিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়কে বাস্তবায়নের জন্য সমাজে দানশীল ও বিত্তবানরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায়। প্রবীণদের জন্য সামাজিক আন্দোলনে তরুণদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন; কারণ প্রবীণদের এ সমস্যা সমাধান না হলে আগামীতে ভুক্তভোগী হবে বর্তমান তরুণ প্রজন্মই।