নিউজ ডেস্ক:
জিকির শব্দের আভিধানিক অর্থ স্মরণ করা, মনে করা। শরিয়তের আলোকে জিকির বলা হয় মুখে বা অন্তরে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা এবং প্রশংসা করা, পবিত্র কোরআন পাঠ করা, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা, তার আদেশ-নিষেধ পালন করা, তার প্রদত্ত নেয়ামত ও সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, জিকির কেবল তাসবিহ-তাহলিল, তাহমিদ, তাকবির ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আনুগত্যের সঙ্গে প্রত্যেক আমলকারীই জিকিরকারী হিসেবে বিবেচিত।
সময় আল্লাহর অমূল্য দান। অনর্থক কাজে এ মহামূল্যবান জিনিস নষ্ট করা বান্দার শোভা পায় না। তাই বান্দার উচিত যখনই সুযোগ হয়, আল্লাহর জিকিরে মশগুল হওয়া। আমাদের বুজুর্গানে দ্বীনের নিত্যকার আমল ছিল, দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় জিকিরে মশগুল থাকা। জিকিরের মাধ্যমে সহজেই তাঁরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছেন।
আল্লাহ তায়ালার জিকির এমন এক মজবুত মাধ্যম, যা সৃষ্টিকে স্রষ্টার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করে দেয়; তাঁর সান্নিধ্য লাভের পথ সুগম করে। মানুষকে উত্তম আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে, সরল ও সঠিক পথের ওপর অবিচল রাখে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির কর।’ (সুরা আহজাব : ৪১)। এ আয়াতে অধিক পরিমাণে জিকির বলতে কী উদ্দেশ্য, তা অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন, ‘যখন তোমরা নামাজ আদায় করবে, তখন আল্লাহর জিকির করÑ দাঁডিয়ে, বসে বা কাত হয়ে।’ (সুরা নিসা : ১০৩)। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা মুমিন ব্যক্তিকে দিনে-রাতে, প্রকাশ্যে-গোপনে জিকির করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, তোমরা মনে মনে তোমাদের প্রতিপালককে বিনয় ও শঙ্কাচিত্তে এবং অনুচ্চস্বরে প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় স্মরণ করবে এবং তুমি উদাসীন হবে না।’ (সুরা আরাফ : ২০৫)। অন্য আয়াতে জিকিরকারীকে জ্ঞানী উপাধি দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারাই জ্ঞানী যারা দাঁড়ানো, বসা এবং শোয়া অবস্থায় তথা সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯১)।
জিকিরকারীর জন্য রয়েছে অসংখ্য পুরস্কার এবং নিশ্চিত জান্নাতের সুসংবাদ। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন এক আমল সম্পর্কে অবহিত করব না, যা তোমাদের রবের কাছে সবচেয়ে উত্তম, পবিত্র ও তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধিকারী এবং তোমরা আল্লাহর রাস্তায় স্বর্ণ-রূপা দান করা ও দুশমনের মুখোমুখি হয়ে তোমরা তাদের গর্দানে বা তারা তোমাদের গর্দানে আঘাত করার চেয়ে উত্তম? তারা বলল, হ্যাঁ ইয়া রাসুলুল্লাহ! তিনি বললেন, তা হলো, আল্লাহর জিকির বা স্মরণ।’ (তিরমিজি : ৩২৯৯)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী পুরুষ ও মহিলার জন্য আল্লাহ তায়ালা মাগফিরাত ও প্রতিদানের ব্যবস্থা রেখেছেন।’ (সুরা আহজাব : ৩৫)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, বান্দা আমার ব্যাপারে যেমন ধারণা করবে, তেমনই আমাকে পাবে। আমাকে যখন সে স্মরণ করে আমি তার সঙ্গে থাকি। সে যদি আমাকে তার অন্তরে স্মরণ করে, তাহলে আমিও তাকে আমার অন্তরে স্মরণ করি। আর যদি সে আমাকে কোনো জনগোষ্ঠীর কাছে স্মরণ করে, তাহলে আমি তাকে তাদের চেয়ে উত্তম জনগোষ্ঠীর কাছে স্মরণ করি। সে যদি আমার দিকে অর্ধ হাত এগিয়ে আসে, তাহলে আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে আসি। আর যদি সে এক হাত এগিয়ে আসে, তাহলে আমি তার দিকে হস্তদ্বয় প্রসারিত পরিমাণ এগিয়ে আসি। যদি সে আমার দিকে হেঁটে আসে, তাহলে আমি তার দিকে দ্রুত হেঁটে আসি।’ (মুসলিম : ৬৮৪৪)।
জিকিরের প্রকারভেদ
জিকির মনে মনে হতে পারে, জিহ্বা দ্বারা হতে পারে বা একসঙ্গে উভয়টা দ্বারাও হতে পারে। এর বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। নিচে কিছু উল্লেখ করা হলো ১. মৌখিক জিকির : যেমন, তাসবিহ-তাহলিল, তাহমিদ ও তাকবির ইত্যাদি পড়া, যা কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। ২. প্রার্থনা : এটা বিশেষ জিকির। কারণ এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ হয়, ইহকাল ও পরকালের প্রয়োজন পূরণ হয়। ৩. ইস্তিগফার করা : আল্লাহ তায়ালা হজরত নুহ (আ.) এর কথা বিবৃত করে বলেন, ‘বলেছি, তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা প্রার্থনা কর, তিনি তো মহাক্ষমাশীল।’ (সুরা নুহ : ১০)। ৪. অন্তর দিয়ে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করা। ৫. বিভিন্ন ইবাদতও জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন নামাজ পড়া, জাকাত দেয়া, বাবা-মায়ের সঙ্গে অমায়িক আচরণ করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা, জ্ঞানার্জন ও অপরকে শিক্ষাদান ইত্যাদি। কেননা সৎকর্মের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহকে স্মরণ করা।
জিকির করার সময় এ হিসেবে জিকিরকে আমরা দুই ভাগে বিভক্ত করতে পারি। যেমন ১. সাধারণ জিকির, যার কোনো নির্দিষ্ট সময় বা স্থান নেই। নির্দিষ্ট সময় বা স্থান ছাড়া যে কোনো সময় বা স্থানে এসব জিকির করার অবকাশ আছে। ২. বিশেষ জিকির, যা বিশেষ সময়, অবস্থা ও পাত্র অনুসারে করা হয়। নিচে এমন কিছু সময়, অবস্থা ও স্থানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো, যার সঙ্গে জিকিরের বিশেষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
এক. সকাল এবং বিকাল : এর সময় হচ্ছে ফজর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত, আসরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। দুই. ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠার সময়। তিন. ঘরে প্রবেশের সময়। চার. মসজিদে প্রবেশ ও মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময়। পাঁচ. অসুস্থতার সময়। ছয়. বিপদাপদ ও পেরেশানির সময়। সাত. সফরের সময় ইত্যাদি।
হাদিসে বর্ণিত দৈনন্দিন আমল করার কিছু ফজিলতপূর্ণ জিকির
১. প্রতিদিন একশবার ‘সুবহানাল্লাহ’ পাঠ করলে এক হাজার সাওয়াব লেখা হয় এবং এক হাজার গোনাহ মাফ করা হয়। (মুসলিম : ২০৭৩)।
২. ‘আলহামদুলিল্লাহ’ মিজানের পাল্লাকে ভারি করে দেয় এবং এটি সর্বোত্তম দোয়া। (তিরমিজি : ৪৬২, ইবনে মাজাহ : ১২৪৯)।
৩. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সর্বোত্তম জিকির। (তিরমিজি : ৪৬২)।
৪. ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর’ এই কালেমাগুলো আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় এবং নবী করিম (সা.) বলেন, ‘পৃথিবীর সব জিনিসের চেয়ে আমার কাছে বেশি প্রিয়।’ (মুসলিম : ১৬৮৫)।
৫. যে ব্যক্তি ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’ প্রতিদিন একশবার পাঠ করবে সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ গোনাহ থাকলেও মাফ করে দেওয়া হবে। (বোখারি : ১৬৮)।
৬. নবী করিম (সা.) বলেন, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম’ এ কালেমাগুলো জিহ্বায় উচ্চারণে সহজ, মিজানের পাল্লায় ভারি, দয়াময় আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয়।’ (বোখারি : ১৬৮)।
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম