খুলনার দৌলতপুরের রহিমা বেগমকে (৫২) ‘আত্মগোপনরত’ অবস্থায় শনিবার রাতে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার বোয়ালমারী ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে রহিমা বেগম দাবি করেছেন, তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। তবে কুদ্দুস মোল্লার স্বজনদের কাছে তিনি জানিয়েছিলেন, জমি বিক্রি সংক্রান্ত বিষয়ে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে রাগ করে তিনি ঘর ছেড়েছেন।
রহিমা বেগম ফরিদপুরের যার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই কুদ্দুস মোল্লার ভাগনে মোহাম্মদ জয়নাল আবেদিন জানান, গত শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ফেসবুকসহ বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে তিনি রহিমা বেগমের ছবি দেখতে পান। তিনি তাকে শনাক্ত করেন। ওই ছবি দেখানো হয় রহিমা বেগমকে। তিনি ছবিটি নিজের বলে স্বীকার করেন।
ছবি দেখার পর রহিমা জয়নালকে জানান, ছেলেমেয়েরা তাকে পছন্দ করেন না। তিনি বাড়িতে ফিরে যাবেন না। তিনি বাড়িতে গেলে তাকে মেরে ফেলা হবে।
রহিমা আরও জানান, তিনি মৃত স্বামী মান্নানের কাছ থেকে পাঁচ শতাংশ (দুই কাঠা) জমি পেয়েছেন। ছেলে মেয়েরা এ জমি বিক্রির জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। জমি বিক্রির পর তারা টাকা নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাতে রাজি না হয়ে রাগ করে চলে এসেছেন তিনি।
জয়নাল আবেদিন আরও জানান, এ ঘটনা জানার পর কুদ্দুসের ছেলে আল আমিন রহিমার মেয়ে মরিয়ম মান্নানের ফেসবুক আইডিতে এ বিষয়ে কমেন্ট করেছিলেন। কিন্তু তিনি (মরিয়ম মান্নান) কোনো উত্তর দেননি। এ ছাড়া ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করে তিনি রহিমা বেগমের ছেলে মিজানের নম্বর পেয়েছিলেন। সেই নম্বরে কল দিলে এক নারী রিসিভ করে বলেন, এই নম্বরে আর কল দেবেন না। এই বলে তিনি কল কেটে দেন। এরপর রহিমা বেগমের পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন পোর্টালে ছবি দেখার পর রহিমা বেগমকে সতর্কতার সঙ্গে দেখে রাখেন কুদ্দুসের ভাগনে জয়নাল ও জামাতা নূর মোহাম্মদ। গত শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সকালে স্থানীয় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মোশারফ মোল্লাকে এ বিষয়টি জানান তারা।
মোশারফ মোল্লা খুলনা ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের সহযোগিতায় বিষয়টি খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশকে জানান। পরে পুলিশ মোশাররফ মোল্লার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়, রহিমা বেগম সৈয়দপুর গ্রামে আছেন। পুলিশ রহিমা বেগমকে নজরে রাখতে বলে। রহিমা যেন কোথাও চলে না যান সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে বলা হয়। পরে শনিবার রাতে পুলিশ এসে রহিমা বেগমকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
কুদ্দুস মোল্লার মেয়ের জামাই নূর মোহাম্মদ জানান, রহিমা বেগম কেন এবং কী কারণে এ বাড়িতে এসেছে তা তিনি তার শাশুড়ির কাছে জানতে চান। শাশুড়ি জানান, খুলনায় থাকাকালে রহিমার সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। সেই সূত্রে তিনি বেড়াতে এসেছেন।
কুদ্দুসের মেয়ে ও নূর মোহাম্মদের স্ত্রী সুমাইয়া বেগম বলেন, রহিমা বেগম বাড়িতে স্বাভাবিকভাবেই দিন কাটিয়েছেন। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। এ বাড়ি, ও বাড়িতে বেড়াতেও গিয়েছেন। তবে রহিমা বেগমের চোখের সমস্যা ছিল। চোখ দিয়ে পানি পড়ত। এজন্য তাকে বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে চিকিৎসককে দেখানো হয়।
সুরাইয়া জানান, রহিমা বেগম তাকে বলেছেন, জমি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে গন্ডগোল হয়েছে, ঝামেলা চলছে। এ ঝামেলার জন্য তাকে মারধরও করা হয়েছে। তাই তিনি বাড়ি থেকে চলে এসেছেন। যদিও তার শরীরে মারপিটের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে তিনি শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল ছিলেন।
এর মধ্যেই জন্ম নিবন্ধনের কার্ড পেতে বোয়ালমারী ইউনিয়নে যান রহিমা বেগম। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল হক শেখ বলেন, গত ২২ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টার দিকে রহিমা বেগম আমার পরিষদে আসেন। এসে তিনি আমাকে বলেন, তার জন্ম এ ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। কিন্তু ঘটনাচক্রে তিনি বেড়ে ওঠেন বাগেরহাট জেলায়। সেখানে বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে খান। তিনি সৈয়দপুর গ্রামে বাবার সম্পত্তি ভাইদের থেকে বুঝে নিতে এসেছেন। এজন্য তার নাগরিকত্ব সনদ দরকার।
চেয়ারম্যান তার কাছে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে জন্মগ্রহণের প্রমাণ চান এবং ওই ইউপি সদস্যের সুপারিশ চান। এ কথা শুনে তিনি আর কোনো কথা না বলে তাড়াহুড়ো করে ইউনিয়ন পরিষদ ত্যাগ করেন। পরে ইউপি চেয়ারম্যান ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মোশাররফ হোসেন মোল্লাকে খোঁজ নিতে বলেন। ইউপি সদস্য খোঁজ নিয়ে চেয়ারম্যানকে জানান, রহিমা বেগমের জন্ম তার ওয়ার্ডে নয়। তিনি কুদ্দুস মোল্লার খুলনার ভাড়া বাসার মালিক।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মোশাররফ হোসেন মোল্লা বলেন, কুদ্দুস মোল্লা খুলনা থেকে গ্রামের বাড়ি সৈয়দপুরে ফিরে এসে স্থানীয় জনতা জুট মিলের শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। গতকাল রাতে রহিমা বেগমের সঙ্গে কুদ্দুসের স্ত্রী-পুত্রসহ পুলিশ তিনজনকে নিয়ে গেছে। পুলিশ জানিয়েছে, তাদের কোনো ভয় নেই। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে।
বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব বলেন, রহিমা বেগম যে বোয়ালমারীতে এ কদিন ছিলেন, সে সম্পর্কে আমরা অবগত ছিলাম না। গতকাল খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ এসে আমাদের বিষয়টি জানায়। অভিযানে সাহায্য করে বোয়ালমারী থানা পুলিশ।
আজ রবিবার বেলা ১১টার দিকে রহিমা বেগমকে পুলিশ বুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) খুলনা কার্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়। পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকুর রহমান জানিয়েছেন, রহিমা বেগম দাবি করেছেন, তাকে অপহরণ করা হয়েছিল।
গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনা মহানগরীর মহেশ্বরপাশার উত্তর বণিকপাড়ার নিজ বাসা থেকে টিউবওয়েলে পানি আনতে গিয়ে রহিমা বেগম নিখোঁজ হন বলে দাবি করেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান। রহিমা বেগমের সন্ধানে সন্তানরা কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কখনো মাইকিং, কখনো আত্মীয়স্বজনদের দ্বারস্থ হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনের পর মাকে খুঁজে পেতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর দৌলতপুর থানায় মামলাও দায়ের করেন তারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বাদীর আবেদনের পর এ মামলার তদন্তের ভার পায় পিবিআই। ১৭ সেপ্টেম্বর দৌলতপুর থানা থেকে মামলাটি পিবিআইয়ে স্থানান্তর করা হয়।