বুধবার, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
বুধবার, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫

চুলের সৌন্দর্য চর্চায় ইসলামের নির্দেশনা

ইসলাম নারীদের সৌন্দর্যচর্চায় নিষিদ্ধ করেনি; বরং শালীনতা, পর্দা ও সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। চুলের যত্ন ও সাজসজ্জার অনুমোদনে ইসলামের নির্দেশনা নারীদের ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যের প্রতি যত্নবান হতে উদ্বুদ্ধ করে। এর পাশাপাশি ধর্মীয় আদর্শ বজায় রাখতে সহায়ক হয়।

চুল সৌন্দর্যের প্রতীক:

চুল মানবদেহে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে এটা নারীদের আত্মবিশ্বাস ও সৌন্দর্যের প্রতীক। নবীপত্নীদের লম্বা লম্বা চুল ছিল। সঙ্গত কারণেই ইসলাম নারীদের মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছাঁটাকে হারাম করেছে। হজ-ওমরাহর মৌসুমেও নারীদের জন্য মাথা মুণ্ডন করার অনুমোদিত দেয়নি।

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, স্ত্রীলোকদের জন্য মাথা মুণ্ডনের দরকার নেই, বরং তারা (এক আঙ্গুল পরিমাণ চুল) কর্তন করবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৯৮১)

চুল কাটার বিধান:

নারীদের চুল বড় আর পুরুষের চুল ছোট থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ছোট মেয়ে ছাড়া বড় মেয়েদের চুল কাটার কোন প্রশ্নই আসে না। তবে অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার প্রয়োজনে চুল ছোট করা, এমনকি কামানোর অনুমতি রয়েছে। চুল বেশি বড় থাকলে যেমন কোমর সমান চুল থাকলে চার আঙ্গুলের বেশি পিঠের মাঝামাঝি করে কাটা কিংবা প্রয়োজনে চুলের সামনে ও পিছনের থেকে এলোমেলো অংশ ছেঁটে সোজা করা জায়েজ।

এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো- এক. বিজাতীয় ফ্যাশনের অনুকরণ করা যাবে না। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের অনুসরণ-অনুকরণ করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৯৮৯)

দুই. পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করা যাবে না। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নারীর সাদৃশ্য গ্রহণকারী পুরুষদের ওপর এবং পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণকারী নারীদের ওপর রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৮৮৫)

চুলের পরিচর্যা করা:

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে চুলের পরিচর্যা করতেন এবং অন্যদের চুল পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাখার নির্দেশ দিতেন। জাবির (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের কাছে এসে এক ব্যক্তির মাথার চুল আলু থালু দেখে বলেন, এ ব্যক্তির কি চুল আচড়ানোর মতো কিছু নেই। অন্য এক ব্যক্তির পরিধানে ময়লা কাপড় দেখে বলেন, সে কি তার কাপড় ধোয়ার জন্য পানি পায় না? (আবু দাউদ, হাদিস: ৪০১৮)

বেশিরভাগ নারী চুলের যত্নে সচেতন। চুল বাধার বিভিন্ন স্টাইল তার প্রমাণ। তারা চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ঘরোয়া উপাদানের পাশাপাশি বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্রান্ডের শ্যাম্পু ও তেল ব্যবহার করে। নারীদের পাকা চুলে কলপ ব্যবহার করার অনুমতি আছে। তবে কালো রঙের কলপ ব্যবহার হারাম।

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শেষ যুগে এমন সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হবে যারা কবুতরের সিনার মত কালো রংয়ের খেজাব লাগাবে। তারা জান্নাতের খোশবুও পাবে না। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪১৬৪)

চুলের সৌন্দর্য ধরে রাখতে অতিরিক্ত কেমিক্যালের ওপর ভরসা না করে পুষ্টিকর ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত। এতে চুল ঝলমলে সুন্দর ও দীর্ঘস্থায়ী হয় ।

পরচুলা ব্যবহার প্রতারণা:

বর্তমানে কৃত্রিম চুল সংযোজন ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এটি মূলত মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য পরিবর্তনের প্রচেষ্টা। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তনের শামিল। তাই পরচুলা ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব (রহ.) থেকে বর্ণিত ।

তিনি বলেন, মুআবিয়া (রা.) শেষ বারের মতো যখন মদিনায় আসেন, তখন তিনি আমাদের সামনে ভাষণ দেন। তিনি এক গোছা চুল বের করে বলেন, আমি ইহুদি ছাড়া অন্য কাউকে এ জিনিস ব্যবহার করতে দেখিনি। রাসুল (সা.) একে অর্থাৎ পরচুলা ব্যবহারকারী নারীকে প্রতারক বলেছেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৫১৩)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ ওই নারীর উপর অভিশাপ বর্ষণ করেন, যে পরচুলা লাগায়, আর অপরকে পরচুলা লাগিয়ে দেয়। আর যে নারী উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যে তা করায়।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৫১২)

চুল ঢাকা অপরিহার্য:

নারীদের চুল সতরের অন্তর্ভুক্ত। পরপুরুষকে দেখানো হারাম। নামাজের সময় নারীদের পুরো মাথার চুল ঢেকে নামাজ আদায় করতে হয়। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তবে যা সাধারণত প্রকাশ হয়ে থাকে আর তারা তাদের গলা ও বুক যেন মাথার কাপড় দ্বারা ঢেকে রাখে।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩১)

জাহেলি যুগের নারীরা মাথায় এক ধরনের আঁটসাঁট বাঁধন দিতো। মাথার পেছনে চুলের খোঁপার সঙ্গে এর গিরো বাঁধা থাকতো। সামনের দিকে বুকের একটি অংশ খোলা থাকতো। সেখানে গলা ও বুকের উপরের দিকের অংশটি পরিষ্কার দেখা যেত। তাই মুসলিম নারীদের আদেশ করা হয়েছে তারা যেন এরূপ না করে বরং ওড়নার উভয় প্রান্ত পরস্পর উল্টিয়ে রাখে। এতে করে যেন সকল অঙ্গ আবৃত হয়ে পড়ে।

আয়েশা (রা.) বলেন, যখন এ আয়াত, তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন ওড়না দ্বারা আবৃত করে অবতীর্ণ হলো তখন মুহাজির নারীরা তাদের তহবন্দের পার্শ্ব ছিঁড়ে তা ওড়না হিসাবে ব্যবহার করতে লাগল। (বুখারি, হাদিস : ৪৭৫৯)

চুল প্রদর্শনের শাসিত:

গ্রাম-শহরের অধিকাংশ নারী আলেম-ওলামা দেখলে মাথায় কাপড় দেয়। মনে করে এটাই নিয়ম। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আলেম হোক কিংবা সাধারণ মানুষ হোক; পরপুরুষকে নিজের চুল দেখানো যায় না।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জাহান্নামবাসী দুই ধরনের লোক এমন আছে যাদের আমি (এখনো) দেখতে পাইনি। একদল লোক, যাদের সাথে গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, তা দিয়ে তারা লোকজনকে পিটাবে। আর এক দল স্ত্রীলোক, যারা বস্ত্র পরিহিত হয়েও বিবস্ত্রা, (সুখ সম্পদ ভোগকারিনী হয়েও অকৃতজ্ঞ) যারা অন্যদের আকর্ষণকারিণী ও আকৃষ্টা, তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের ন্যায়। ওরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি তার ঘ্রাণও পাবে না। অথচ এত এত দূর থেকে তার খুশবু পাওয়া যায়। (মুসলিম, হাদিস : ৫৩৯৭)

কর্তিত চুলের বিধান:

কাটা চুল মাটির নিচে দাফন করে দেয়া উত্তম। কোনো ভালো জায়গায় ফেলে দেয়াও জায়েজ আছে, কিন্তু নাপাক ও খারাপ স্থানে ফেলা ঠিক নয়। এমনিভাবে এমন স্থানেও ফেলা উচিত নয়, যেখানে তা কোনো গায়ের মাহরামের নজরে পড়তে পারে। গ্রামে-গঞ্জে ফেরিওয়ালাদের কাছে চুল বিক্রি করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এটা নাজায়েজ কাজ। এ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

লেখক : খতিব ও মাদ্রাসা শিক্ষক, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর।

Similar Articles

Advertismentspot_img

Most Popular