পুঁজির ঘাটতি, ডলারের উচ্চমূল্য, গ্যাস ও বিদ্যুৎসংকটে ভুগছে দেশের বড় শিল্পকারখানাগুলো। ফলে রড, সিমেন্ট, সিরামিক ও বস্ত্র খাতের মতো বৃহৎ শিল্পগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি বড় প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় নির্মাণশিল্পের তৈরি উপকরণ সিমেন্ট ও রডের চাহিদা ভোক্তাপর্যায়ে ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ফলে এখন চতুর্মুখী সংকটে পড়েছে দেশের শিল্প খাত।
সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ৩ হাজারের বেশি বৃহৎ শিল্প রয়েছে দেশে। মোট কর্মসংস্থানের ৬৮ শতাংশই উৎপাদনমুখী শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া কাঁচামালের ৬৩ শতাংশ ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির ৫৬ শতাংশই ব্যবহার করে রড-সিমেন্ট, বস্ত্র খাতের মতো বৃহৎ শিল্পগুলো। ফলে ডলারের উচ্চমূল্য এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎসংকট এসব শিল্পের উৎপাদনে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর ওপর বাজারে চাহিদা না থাকায় মিল মালিকরা বিপাকে পড়েছেন। অনেকেই পুঁজি হারানোর শঙ্কায় আছেন।
রড-সিমেন্টের চাহিদা ও উৎপাদন নিম্নমুখী: আগের বছরের তুলনায় ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে (সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর) উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে রড ও সিমেন্টের চাহিদা। এই দুটি শিল্পের তথ্য বলছে, বাজারে সিমেন্টের চাহিদা কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ; অপরদিকে রডের চাহিদা কমেছে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদনকারীরা এখন দাম কমিয়ে বাজার ধরে রাখতে চাইছেন। তাতেও কাজ হচ্ছে না।
সিমেন্ট তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডায়মন্ড সিমেন্ট’-এর জেনারেল ম্যানেজার আবদুর রহিম বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি বড় নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় সিমেন্টের চাহিদা বর্তমানে অনেক কম। ফলে কারখানার উৎপাদনও কমেছে। সাধারণত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সিমেন্টের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। কিন্তু এবার প্রত্যাশিত বিক্রি হচ্ছে না।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত বছরগুলোতে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এ তিন মাস রড ও সিমেন্টের দাম থাকে ঊর্ধ্বমুখী। গত বছরও এ সময়ে রড বিক্রি হয়েছে টনপ্রতি ১ লাখ ৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৭ হাজারের মধ্যে। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। চলতি বছর রড বিক্রি হচ্ছে টনপ্রতি ৮৫ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকায়। একই অবস্থা সিমেন্টের ক্ষেত্রেও। বর্তমানে সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে কোম্পানি ভেদে প্রতি বস্তা ৪৭০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। গত বছর একই সময়ে যা ছিল ৪৯০ থেকে ৫৩০ টাকা। উৎপাদনের বিপরীতে চাহিদা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। এরই মধ্যে প্রায় সব রড এবং সিমেন্ট কারখানার উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে।
এইচএম স্টিল ও গোল্ডেন ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সরোয়ার আলম বলেন, ‘ভরা মৌসুমেও বিক্রিতে প্রত্যাশিত সাড়া পাচ্ছে না রড-সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রী তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ সময়ে বেচাবিক্রি থাকে বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি। সরকারি-বেসরকারি বড় এবং মাঝারি নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ থাকায় নতুন করে প্রকল্প শুরু না করার প্রভাব পড়েছে এ খাতে। আশার কথা হচ্ছে, ডিসেম্বরের শেষদিকে এসে কিছু কিছু বিক্রি হচ্ছে।’
বেসরকারি ঋণ কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে: বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বরে) মূলধনী যন্ত্র আমদানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৬ শতাংশ কমেছে। ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। অপরদিকে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আমদানি হ্রাস পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার থেকে ২২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে; তবে রিজার্ভ বাড়লেও বাজারে ডলারসংকট কাটেনি। উপরন্তু ডলারের দাম এখনো বেশি। আর ডলারের উচ্চমূল্য রড-সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং ও স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান এস কে মাসুদুল আলম মাসুদ সম্প্রতি বলেন, আমরা ব্যাংকগুলোকে টাকায় এলসি পরিশোধ করলেও কাঁচামাল আমদানি করতে হয় ডলারে। এখন ডলারের দাম ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় উঠে গেছে। ফলে রড ও সিমেন্টশিল্পের যে পুঁজি ছিল তার প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে শুধু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। নির্মাণ উপকরণশিল্পে এ সংকট চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি অচল হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।