নিউজ ডেস্ক:
খাবার ও পানির অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে আফ্রিকার কিছু জনগোষ্ঠী। তিন বেলা খেতে পায় না, মানবিক সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। কঠিন পরিশ্রম করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে তারা। উত্তর উগান্ডার কারামাজং জনগোষ্ঠী তাদের মধ্যে অন্যতম। কারামাজংরা তিন বেলা খাবার তো দূরের কথা, পানি পর্যন্ত ঠিকমত খেতে পায় না। সরকারও পানির ব্যবস্থা করে না। একবার পানি আনতে তাদের ১০ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হয়।
স্প্যানিস ফটোগ্রাফার সুমি সাদুরনি কারামাজং জনগোষ্ঠীর সঙ্গে দীর্ঘদিন বাস করে তাদের জীবনযাপন ক্যামেরাবন্দী করেছেন। তার ক্যামেরায় কারামাজং জনগোষ্ঠীর অবহেলিত জীবনযাপন সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এত অসুবিধার মধ্যে থাকার পরও সরকার এ জনগোষ্ঠীটির দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না।
কারামাজংদের আশপাশে তুরকানা নামের আরেক জনগোষ্ঠী বাস করে। কারামাজংরা তুরকানাদের এলাকা থেকে খাবার সংগ্রহ করেই জীবন ধারণ করে।
কেনিয়ার প্রধান প্রধান আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে কারামাজংরা অন্যতম। তাদেরই একটি শাখা উগান্ডায় বসবাস করে। কেনিয়ায় বসবাস করা কারামাজংদের অবস্থা মোটামুটি ভালো, কিন্তু উগান্ডায় বসবাস করা কারামাজংরা একেবারেই অবহেলিত।
এই জনগোষ্ঠী এতই হুমকির মধ্যে পড়েছে যে দিনে মাত্র একবার খাবার গ্রহণ প্রথা চালু করেছে তারা। মাত্র এক মগ জব বা ভুট্টা দিয়ে একটি পরিবার ছয় দিন চলে। কয়েক বছর আগেও তারা দিনে তিনবার খেত, কিন্তু এখন তারা দিনে মাত্র একবার খায়। পরিবারের দুরাবস্থার কারণে পরিবারের ছোট ছোট শিশুদেরও কাজে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে কারামাজংরা। কারণ, বেঁচে থাকার জন্য কঠিন পরিশ্রম ছাড়া কোনো উপায় নেই তাদের।
এসব শিশু প্রায় ১০ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পরিবারের জন্য পানি আনতে নলকূপ বা নদীতে যায়।
পানির অভাবে একবার খাবার খেতেও তাদের ঝামেলায় পড়তে হয়। আফ্রিকার মরুভূমিতে পানি সঙ্কট প্রবল। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পানি খুঁজতেই বেরিয়ে যায় ১০ ঘণ্টা। কারামাজংদের জীবন যাযাবরদের মত। তারা কখনো এক স্থানে বেশিদিন থাকে না। এখানে সেখানে তাদের পোষা প্রাণিগুলো নিয়ে বসবাস করে। তাই কোথাও স্থায়ীভাবে পানির ব্যবস্থাও করে না তারা।
এ তো গেল খাবারের বিষয়। প্রকৃতিও কারামাজংদের নির্যাতন করতে ছাড়ে না। মরুভূমিতে বেশিরভাগ সময় বালিঝড় হয়। এ বালিঝড় ছোটখাটো কুটির থাকলে তা নিমিষেই গুড়িয়ে দেয়। বাইরে বালিঝড় থেকে বাঁচার জন্য তারা এক ধরনের লম্বা ঐতিহ্যবাহী পোশাক ব্যবহার করে তারা। কিন্তু সে পোশাক বালিঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম নয়।
কারামাজংদের জীবন নির্বাহের প্রধান উপায় হলো গরু পালন। ছবিতে এক রাখাল যুবক গরুর পাল নিয়ে মাঠে যাচ্ছে।
ফটোগ্রাফার সুমি সাদুরনি বলেন, ‘আমি এ জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন সম্পর্কে মানুষকে জানানোর জন্য ছবিগুলো তুলে তা প্রকাশ করেছি। এমনিতেই আফ্রিকান আবহাওয়ার খুবই উত্তপ্ত। আর দিনদিন তাপমাত্রা আরো বেড়েই চলেছে। এজন্য কারামাজংদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। প্রতিদিন পানির জন্য এদিক সেদিক ছুটে বেড়াতে হয় তাদের। পানি ছাড়া কোনো খাবার নেই, আর খাবার ছাড়া কোনো জীবের আস্তিত্বও নেই। কারামাজং জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে আগেই তাদের বেঁচে থাকার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হয়। সারাবিশ্ব আজ মৌলিক অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করছে, সেখানে কারামাজংরা শুধু বেঁচে থাকার জন্য আকুতি জানাচ্ছে।’
মানবেতর জীবনযাপন করা মারকো নামের এক কারামাজং যুবক বলেন, ‘আমার সাত সন্তান। তাদের নিয়ে জীবনযাপন করা আমার খুব কঠিন। পেটভরে তাদেরকে খাওয়াতে পারি না। আগের থেকে খাবারের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছি। দিনে মাত্র একবার খাই, বাকি সময় না খেয়ে থাকি।’
মাঝে মাঝেই মরুভূমিতে বালিঝড় হয়। এ বালি ঝড় থেকে বাঁচার জন্য এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ব্যবহার করে কারমাজংরা।
প্রতিদিনের রুটিনের বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি জানান, সকালে উঠে সে তার পোষা গরুগুলো গণনা করেন। তারপর তাদের সামান্য খাবারের ব্যবস্থা করে পানি আনতে যান। বিকেলের দিকে পানি নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তারপর আবার খাবার সংগ্রহের জন্য ছুটে যান।
ফটোগ্রাফার সুমি সাদুরনি আরো বলেন, ‘আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর মধ্যে কারামাজংরাই হলো সবচেয়ে অবহেলিত। আমার ছবিগুলো দেখে মানুষ তাদের সম্পর্কে জানতে পারবে। আর জানলেই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তারাও নতুন করে বাঁচার আশা পাবে।’
মরুভূমিতে মাঝে মাঝে সবুজের সমারহও দেখা যায়। কিন্তু তারপরও আবহাওয়া কারামাজংদের প্রতিকূলে থাকে।
দুই কারামাজং নারী। পাহাড়ে কাঠসহ অন্যান্য জিনিসপত্র সংগ্রহের পর স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করে তারা।
কয়েক মাইল পর পর একটি করে সরকারি নলকূপ দেওয়া হয়েছে। সেই নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছে কারামাজংরা।
উগান্ডার নাপাক জেলায় খুবই দরিদ্র মানুষের বাস। তাই ছোট শিশুদেরও কাজে লাগায় বাবা মা। মাথায় খাদ্যশষ্য নিয়ে পরিবারের কাছে যাচ্ছে এই কিশোর।
বামের ছবিতে এক কারামাজং যুবকের মুখে ছোট ছোট দাগ কাটা। ডানের ছবিতে পোকোট জনগোষ্ঠীর এক নারী। কারামাজং ও পোকোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ।
গ্রীষ্মকালে খরায় হাহাকার করে কারামাজংদের এলাকা। দুপুরে সেখানে আগুনের বাতাস বয়। ছবিতে প্রচণ্ড খরায় মারা গেছে গাছটি।
মরুভূমির পাশে কিছু কুটির থাকলেও কারামাজংরা সেখানে থাকতে পারে না। কারণ তাদের পেশা পশুপালন। বিভিন্ন স্থানে ছুটে চলতে হয় তাদের।
ছেলেকে নিয়ে মাঠে বসে আছেন এক বাবা। তার পাশে খরায় শুকিয়ে যাওয়া ঘাস।
প্রতিকূল পরিবেশে বড় হওয়ায় খুব ছোটবেলায় বাড়ির ছোট ছোট কাজ করতে শুরু করে কারামাজং শিশুরা। ছবিতে গরু চরাতে নিয়ে আসা দুই শিশু।
মুরগি পালন করে কারামাজংরা। ছবিতে মাচা তৈরি করে মুরগি পালন দেখানো হয়েছে।
কয়েকজন কারামাজং গরুর রাখাল। হাতে তাদের পানির পাত্র। সবসময় পানির পাত্র সঙ্গে রাখে তারা। কারণ একবার পানির আনতে পায় ১০ ঘণ্টা সময় লাগে তাদের।
কারামাজং নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করে। ছবিতে কয়েকজন নারী গরুর রাখালী করছে।
ছবিতে দুটি কারামাজং শিশু ছাগল চারণ করাতে এসেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে খরার কারণে সেখানে কোনো ঘাসও জন্মাতে পারেনি।
উত্তর আফ্রিকার মরুভূমি। গ্রীষ্মের সময় মাটির রঙ শুকিয়ে লাল হয়ে যায়। পানির অস্তিত্ব থাকে না মাইলের পর মাইল।
বামে এক কিশোরী তার ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে আদর করছে। এভাবেই বড় সন্তানরা পরিবারে সহযোগিতা করে থাকেন। ছবির ডানে দাঁড়িয়ে কয়েকজন কারামাজং নারী।
গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করছে এক কারামাজং শিশু। এভাবে কাজ করেই পরিবার সহযোগিতা করে কারামাজং শিশুরা।
নাপাক জেলায় দুই মেয়ের সঙ্গে এক কারামাজং নারী। পেছনে তাদের ছোট্ট কুটির।
খাবারের অভাবে মাত্র এক মগ জব বা ভুট্টার দানা দিয়ে একটি মাঝারি পরিবার ছয় দিন চলে। অভাবের কারণে দিনে একবার খাবার ব্যবস্থা চালু করেছে কারামাজংরা।
গরুগুলোই কারামাজংদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। ছবিতে একটি গরুর মুখে বিশেষ দাগ দেওয়া হয়েছে, যেন গরু চোর বা রোগবালাইয়ের হাত থেকে গরুটি সুরক্ষিত থাকে।
কুটিরের পাশে রঙিন পোশাক পরা এক কারামাজং যুবক।
কারমাজংদের জীবন যাপন ও ওই এলাকার সার্বিক অবস্থা নিয়ে ‘ল্যান্ড অব থ্রোনস’ নামে একটি ডকুমেন্টরি ফিল্ম তৈরি করা হয়েছে। সেই ভিডিওটি পাঠকদের জন্য দেওয়া হলো-