নিউজ ডেস্ক:
তদন্ত সঠিক পথে নেই বলে দীর্ঘ প্রায় ৬ বছরেও চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না। এমনটাই মনে করছেন মেহেরুন রুনির পরিবার, সহকর্মী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।
তারা বলছেন কোন একটি পক্ষ বাধা সৃষ্টি করায় মামলার তদন্তে অগ্রগতি হচ্ছে না। অবশ্য এই বিষয়ে এমনকি এই মামলা নিয়েই এখন আর কোন কথা বলতে রাজি নয় তদন্তকারি সংস্থা র্যাব।
ইদানিং ক্রিকেটের প্রতি বেশ ঝোঁক মেঘের।
রাজধানীর ইন্দিরা রোডসংলগ্ন টিএন্ডটি মাঠে এক সকালে গিয়ে দেখা যায়, ব্যাট-প্যাড নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত মেঘ।
বাবা সাগর সারওয়ার আর মা মেহেরুন রুনির অভাববোধ হয়তো সবসময়ই থাকবে, তবে এর মধ্যেই জীবনের নিয়মে নানা ব্যস্ততায় নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে সাগর-রুনি দম্পতির বেঁচে যাওয়া এই একমাত্র সন্তান।
এই মাঠেই কথা হয় মেঘের মামা নওশের রোমানের সঙ্গে। মামলার প্রসঙ্গ উঠতেই হতাশা ঝরে পড়লো সাগর-রুনি হত্যা মামলার এই বাদীর কণ্ঠে।
“আমরা আসলে গত দুই বছর ধরে মামলা নিয়ে কিছুই জানতে পারিনি। তারা এ মামলা নিয়ে কোন কথা বলছে না। আগে মিডিয়ার মাধ্যমে কিছুটা হলেও জানতে পারতাম। এখন সেখানেও তারা কথা বলছে না। এসব দেখে মনে হয় যে তারা এখন আর এ মামলার কোন তদন্তই করছে না।”
২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনীদের গ্রেফতারের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এরপর পুলিশ প্রধান জানিয়েছিলেন, তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
কিন্তু এরপরই হঠাৎ থমকে যায় তদন্তের অগ্রগতি। রহস্যের জট তো খোলেইনি বরং আরো ঘণিভূত হয়।
হত্যার কারণ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানারকম গুজব আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন সাংবাদিক হারুন উর রশীদ। তার মতে, তদন্ত সঠিক পথে না থাকাতেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানারকম গুজব ছড়ানো হয়েছিলো।
“প্রভাবশালীরা কেউ জড়িত, অথবা সাগর কোন একটা বই লিখেছে অথবা কোন ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা থেকেও এটি ঘটতে পারে এরকম নানা কথা বাজারে ছড়িয়েছিলো। এমনকি পুলিশ গ্রিল কাটা চোর নিয়ে মহড়া করে সেটা ভিডিও করেছিলো। মানে চোর তত্ত্বও তো বাজারে এসেছে। এরকম নানা তত্ত্ব যখন বাজারে ছড়ায় তখন বোঝা যায় যে, ঘটনার আসল তদন্ত হচ্ছে না। এসব গুজব অনেক সময় আইন-শৃংখলা রক্ষাবাহিনীর পক্ষ থেকেও ছড়ানো হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে।”
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে মামলা হওয়ার পর প্রথমে এর তদন্তে নামে শেরে বাংলা থানা পুলিশ।
চারদিনের মাথায় মামলা হাতবদল হয় ডিবি পুলিশের কাছে। এর ৬২ দিনের মাথায় ডিবি আদালতে ব্যর্থতা স্বীকার করলে তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব।
দায়িত্ব নিয়েই সাগর ও রুনির মরদেহ কবর থেকে তুলে এনে পুনরায় ময়না তদন্ত ও ভিসেরা পরীক্ষা করে র্যাব। বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হলেও তদন্ত আর এগোয়নি।
এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য এখন পর্যন্ত ৫৩ বার সময় নিয়েছেন।
আগামী পহেলা ফেব্রুয়ারি এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ, কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে যতদূর বোঝা যাচ্ছে, এবারও হয়ত তারা সেই প্রতিবেদন জমা দিতে পারবেন না।
কেন এই বিলম্ব, এ নিয়ে বক্তব্য জানতে পুলিশ, র্যাব, র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে বিবিসির তরফ থেকে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তারা কথা বলতে রাজী হননি।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, যিনি শুরু থেকেই এই মামলার কার্যক্রমের উপর নজর রাখছিলেন, বিবিসিকে বলেন, “কয়েকটি কারণে তদন্ত থেমে যেতে পারে। প্রথমত: এ ঘটনায় এমন প্রভাবশালী কেউ জড়িত, যার কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা কারো নেই। দ্বিতীয়ত: এ ঘটনায় এমন একটা পাবিলক পারসেপশন তৈরি হয়েছে যে, এর বিপরীত কোন তথ্য তদন্তে বের হলেও তা প্রকাশ করতে পারছেন না তদন্তকারীরা। কোন মামলায় যখন নানারকম চাপ কিংবা বাধা তৈরি হয়, তখন অনেক সময় তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত শেষ না করে সময়ক্ষেপনের কৌশল নিয়ে থাকেন। এখন বাধাটা কোথায় সেটা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না।”
সাগর-রুনি হত্যার বিচার চেয়ে ঘটনার পরপরই আন্দোলনে নেমেছিলেন অনেকেই।
অল্পকিছুদিন পরই সেই আন্দোলন থেমে গেলেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী পরে হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা।
তবে তিনি কোন বাধার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, তদন্তে সরকারের পক্ষ থেকে কখনোই কোন বাধা দেয়া হয়নি।
হত্যাকাণ্ডের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ৫ বছরের মেঘ এখন ১১ বছরে। তার দু:সহ স্মৃতি ভোলার একটা উপলক্ষ হয়তো হতে পারতো খুনীদের বিচার।
কিন্তু অবস্থা এখন এমন দাড়িয়েছে যে, এই হত্যার বিচার নিয়ে আশাই ছেড়ে দিয়েছেন খোদ সাগর-রুনির পরিবার।
BBC বাংলা