নিউজ ডেস্ক:
বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। পথের দূরত্ব ওর স্বপ্নের পথে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে সেই পথের মোজাম্মেল নামে এক বখাটে। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় রোজ রোজ মুন্নিকে হতে হতো উত্ত্যক্তের শিকার। ছোট্ট মেয়েটি মুখ বুজে থেকেছে। ভয় আর লজ্জায় বাড়িতেও কাউকে কিছু বলে না। নীরবে সয়ে যায় সব কষ্ট।
ফারজানা আক্তার মুন্নি। বছর পনেরোর সেই কিশোরী মেয়েটি স্কুলে যেত। সহপাঠীদের সাথে আড্ডায় মাতিয়ে রাখত স্কুলের আঙিনা। দিনমজুর বাবার বড় সন্তান। পড়াশোনা শেষে চাকরি নেবে, সংসারের দুঃখ মোচন করবেÑ কত স্বপ্ন ছিল মনে। তার সেই স্বপ্নগুলো বিবর্ণ হতে দেরি হলো না।
বাবার কাছে আড়াল রাখে, বাবা যদি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়? তাহলে তো আর চাকরি করা হবে না। দিনমজুর বাবার দুঃখের সংসারের একটুখানি ভার নেয়া হবে না। এসব ভেবে অনেক দিন বখাটেপনা হজম করে গেলেও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় শেষে। স্কুল থেকে ফিরেই একদিন যখন হু হু করে কেঁদে ওঠে, বাবা-মা জানতে চান, কী হয়েছে। সব শুনে স্তম্ভিত সবাই। পরিণতি সেটিই হলোÑ সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা দেয়ার আগেই শিক্ষাজীবনে যতিচিহ্ন!
এরপর কেটে যায় দুই বছর। তত দিনেও পিছু হটেনি সেই বখাটে। এবার বাড়ির আশপাশেই ঘুরঘুর করতে থাকে। মুন্নিকে পেতে একপর্যায়ে পারিবারিকভাবে প্রস্তাবও পাঠায় সে। মুন্নির মা-বাবা কেউই রাজি নন। কারণ, ছেলেটি এলাকার সন্ত্রাসী ও বখাটে।
বিয়ের প্রস্তাবও যখন টিকল না, তখন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে মোজাম্মেল। মুন্নির জীবনই শেষ করে দেয়ার নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে। প্রকাশ্যে হুমকিও দেয় মুন্নিকে আর কারো হতে দেবে না। কিন্তু কে জানত সেই হুমকিটা হুমকির চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে?
ঘরের পাশে জমিতে বসে কাজ করছিল মুন্নি। সাথে ছোট বোনটিও। আগে থেকে পাশের জঙ্গলে ওঁৎ পেতে থাকা মোজাম্মেল হামলে পড়ে মুন্নির ওপর। মুন্নিকে এক ধাক্কায় ফেলে কোপাতে থাকে সাথে আনা চায়নিজ কুড়াল দিয়ে। চোখের সামনে এই নৃশংসতা দেখে মূর্ছা যায় ছোট বোন রাবেয়া। ওর চিৎকারে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলে মোজাম্মেল পালিয়ে যায়।
রক্তাক্ত মুন্নিকে হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল, ওর পিঠের মেরুদণ্ড দুই ভাগ হয়ে গেছে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে পিঠের অনেকগুলো হাড়। সেই থেকে আর উঠে বসতে পারেনি মুন্নি। কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবে কি না, সে নিশ্চয়তাও দিতে পারছেন না চিকিৎসকেরা। মৃত্যুপথযাত্রী মুন্নির চিকিৎসা চলছে সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে।
কথা হয় মুন্নির মা রিজিয়া বেগমের সাথে। ভেঙে ভেঙে কথা বলতে পারছিল মুন্নিও। চোখ ছলছল মুন্নি হতাশায় মুষড়ে পড়ে। মনের ভেতরে সেই সোনালি দিনগুলো ঘোরে। স্কুলের আঙিনা, সহপাঠী, পড়াশোনাÑ এসব মনে পড়তেই হৃদয়টা কেঁদে ওঠে। মোজাম্মেলের এই নৃশংস কোপে কেবল মেরুদণ্ড নয়, ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে এই কিশোরীর রঙিন স্বপ্নও। চিকিৎসাধীন মুন্নি ও তার মা রিজিয়া দু’জনের চোখেই আতঙ্ক আর দুঃস্বপ্ন। মুন্নিকে দেখলে আর এ ঘটনার বিবরণ শুনলে যে-কেউ আঁতকে উঠবেন। অনুভূতিহীন ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী ছাড়া কারো পক্ষে এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। এরপর খণ্ডিত মেরুদণ্ড নিয়ে মুন্নি আর ওই অসহায় দিনমজুর পরিবারটিকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়াতে হয়। মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি চিকিৎসাকেন্দ্র ঘুরে মুন্নির ঠাঁই হয়েছে সাভারের সিআরপিতে।
মুন্নির মা রিজিয়া বলেন, ‘আমার মাইয়ার মুখে সব সময় হাসি লাইগা থাকত। স্কুলে যাইত। খেলত। সব সময় কইত পড়াশোনা শেষে চাকরি কইরব। অ্যাহন সব শেষ অই গেছে। মাইয়া এখন বইতে পারে না। ঠিকমতো কথা কইতে পারে না। সারাক্ষণ কান্দে আর কয়Ñ এভাবে বাঁচি থাকনের চাই মরি যাওয়া ভালো। আমারে ইনজেকশন দিয়া মারি ফ্যালো। অরে আমি কী কমু কন? আমার বুক ফাইটে খালি কান্দন আসে।’ চোখ মুছতে মুছতে তিনি জানান, এ হাসপাতালে আসার পর পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলেও শেষ পর্যন্ত কী হয় তা বলা যাচ্ছে না।
মুন্নির চিকিৎসক সিআরপির হেড অব মেডিক্যাল সার্ভিস উইং ডা: সাঈদ উদ্দিন হেলাল বলেন, ‘কুড়ালের কোপে মুন্নির মেরুদণ্ড দুই ভাগ হয়ে গেছে। পিঠের অনেকগুলো হাড়ও ভেঙে গেছে। আঘাতটি এত মারাত্মক যে, তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পাঁচ মাস ধরে শুয়ে থাকায় ওর পিঠে ঘা হয়ে গেছে। বাইরে থেকে তাকালেই পিঠের মেরুদণ্ড এবং হাড়গোড় দেখা যায়। চেষ্টা চলছে এই ক্ষত শুকানোর।’
চিকিৎসক আরো বলেন, ‘পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে প্লাস্টিক সার্জারি করা হবে। তবে এই অবস্থা থেকে রোগীর উঠে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা মাত্র পাঁচ শতাংশ। চিকিৎসার পর মুন্নি সর্বোচ্চ হয়তো হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে পারবে। তাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’
অভাবেও সুখ ছিল, এখন সুখ উধাও
তিন মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার জাফর-রিজিয়া দম্পতির। দিনমজুরি করে হলেও সংসার ভালোই চালাচ্ছিলেন জাফর। কষ্ট করে হলেও সন্তানদের মানুষ করতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। কিন্তু এক বখাটের কারণে তাদের সুখের সংসার এখন তছনছ হয়ে গেছে। গত জুন মাস থেকে পরিবারের সবাই খেয়ে-না-খেয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন। চোখে ঘুম নেই রিজিয়া ও জাফরের। মেয়েকে বাঁচাতে নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। সংসারের প্রথম সন্তান বলে মুন্নিকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। সেসব স্বপ্ন হারিয়ে গেলেও তারা চান মেয়ে যেন অন্তত সুস্থ হয়ে ওঠে।
সবাইকে মুন্নিদের পাশে দাঁড়াতে হবে
মোজাম্মেলের এই নৃশংসতা সম্পর্কে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো: গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘এই ফুটফুটে কিশোরীর ওপর যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তা ধারণার বাইরে। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই বখাটেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে না।’ মুন্নির চিকিৎসাপ্রক্রিয়ার সাথে নিজের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে গিয়াস বলেন, ‘চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে মেয়েটির পরিবার এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। আমাদের সবার উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। এমন বখাটেদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাও জরুরি।’
বেচতে হয়েছে শেষ সম্বল দেড় কাঠা ভিটে
ঘটনার পর থেকেই মুমূর্ষু মুন্নিকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছেন জাফর ও রিজিয়া। রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটেছে তাদের। রক্তাক্ত মেয়েকে জমি থেকে তুুলে যখন হাসপাতালে যান, সাথে কানাকড়িও ছিল না। বাধ্য হয়ে সুদে ঋণ নিয়েছেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করে টাকা নিয়েছেন। এলাকার লোকজনের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছেন। কিন্তু তাতেও চিকিৎসা খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না বলে শেষ পর্যন্ত ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে তাদের। মাথা গোঁজার জন্য ওই দেড় কাঠার ভিটেই ছিল তাদের সর্বশেষ সম্বল।
জাফর জানান, এই পাঁচ মাসে মুন্নির চিকিৎসার পেছনে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা খরচ হয়েছে তাদের। সুদ দেয়ার শর্তে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তাকে সিআরপিতে ভর্তি করান তারা। গত ৬ নভেম্বর থেকে সিআরপিতে তার চিকিৎসা চলছে। সার্জারি এবং আরো বেশ কিছু চিকিৎসা, ওষুধপথ্য বাকি আছে। কিন্তু হাতে নেই কানাকড়িও। মুন্নিকে বাঁচাতে তাদের সংগ্রাম তাহলে কি শেষ পর্যন্ত অর্থের কাছে হার মানবে?