শেখ হাসিনা পালানোর পর তার পথ ধরেছেন আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কিনা। আবার ক্ষমতার রাজনীতির অংশ হতে পারবেন কি না? যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গণমাধ্যম টাইম ম্যাগাজিন এ নিয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।
‘কীভাবে অসম্ভব প্রত্যাবর্তন ঘটাতে পারেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই সংবাদে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার অচল হয়ে পড়লে যে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সুযোগ বাড়বে, সে বিষয়ে সবাই একমত। বিশ্লেষক জিল্লুর রহমানের মতে, ‘আগামী দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাসিনা ও তার দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হলে এই প্রেক্ষাপট বদলে যেতে পারে।’
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা সবাই কোটা আন্দোলন দেখে অবাক হয়েছিলাম। আসলে আমি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বলেছিলাম, ৩০ শতাংশ কোটা বেশি হয়ে যায়; আমাদের এটি কমিয়ে ৫ শতাংশে নিয়ে আসা উচিত। তখন একজন মন্তব্য করেন, আমরাও মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনি। আমি মজা করে বলেছিলাম, এ জন্যই তো আমি ৫ শতাংশ রাখতে বলেছি!’
শেষ পর্যন্ত কোটা ইস্যু অগ্নিশিখার মতো বৈষম্য ও রাজনৈতিক দমনপীড়নের প্রতি বাংলাদেশের জনসাধারণের ক্ষোভকে উসকে দেয়। জুলাই মাসে এই অস্থিরতা তীব্র আকার ধারণ করে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের সহিংসভাবে দমন-পীড়নের ফলে অন্তত ১ হাজার মানুষ মারা যান।
সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) দেশের পরিস্থিতি নিয়ে খুবই হতাশ। কারণ গত ১৫ বছরে তার সব পরিশ্রম প্রায় বিফলে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশে এখন একটি বড় ধরনের হিসাব-নিকাশ চলছে। ১৫ বছরের অপ্রতিরোধ্য শাসনের সময় হাসিনার দল আওয়ামী লীগ প্রত্যেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এর ফলে সেনাবাহিনী, আদালত, জনসেবা ও বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি গভীর অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে মানুষের মনে।
১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশের পুনর্গঠনের দায়িত্ব পড়েছে ছাত্রনেতা এবং সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর, যারা হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন।
এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনি ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন এবং জাতীয় সংবিধানসহ একটি ছয় দফা সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে। ২৬ আগস্ট এক টেলিভিশন ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ‘দুর্নীতি, লুটপাট এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি দায়বদ্ধ রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই এই সংস্কারের উদ্দেশ্য। এখন যদি আমরা এখন সুযোগ হারাই, আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হব।’
হাসিনার দেশত্যাগের পর কয়েক সপ্তাহ রাজনীতি ও নিরাপত্তাশূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আওয়ামী লীগের লোকজনদের সরানো হয়েছে, অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাজারো পুলিশ সদস্য আত্মগোপনে চলে গেছেন, যাতে জনরোষের শিকার না হন (অন্তত ৪৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন)।
এদিকে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেত্রী খালেদা জিয়া গৃহবন্দি থেকে মুক্তি পেয়েছেন। দেশের প্রধান ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারে কোনো রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি না থাকায় নতুন নির্বাচনের দাবি আরও জোরালো হবে। ‘এই সরকারের বৈধতা আছে, জনসমর্থন আছে, কিন্তু জনপ্রতিনিধিত্ব নেই,’ বলেছেন নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি গবেষক মুবাশ্বার হাসান।
সংস্কারকরা সত্যিই জটিল এক পরিস্থিতিতে পড়েছেন। কার্যকর সংস্কার বাস্তবায়ন করতে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লাগবে। কিন্তু যে দেশে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে খুব শীঘ্রই জনগণ ধৈর্য হারাবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার কারণে গত সপ্তাহে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬.৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.১ শতাংশ করেছে।
জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ হয়নি বলে উল্লেখ করেছিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২২ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ইরানের সঙ্গে যৌথভাবে ১৪৭তম অবস্থানে ছিল এবং তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের এক ধাপ ওপরে ছিল।
সংস্কারপন্থীদের আশঙ্কা দেশকে দ্রুত সংস্কারের দিকে নিয়ে যেতে না পারলে আওয়ামী লীগ আমলের এসব দুর্নীতির স্মৃতি সাধারণ মানুষের স্মৃতি থেকে ফিকে হতে শুরু করতে পারে। উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান, হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারছেন না।
তবে অন্য পর্যবেক্ষকরা হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কুগেলম্যানের মতো এত আত্মবিশ্বাসী নন। সারা বাংলাদেশে হাসিনার পোস্টার ছেঁড়া হয়েছে, বিকৃত করা হয়েছে। তাকে স্বৈরাচার হিসেবে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। ‘তরুণ প্রজন্ম হাসিনার লিগ্যাসিকে এভাবেই দেখছে,’ বলেন মুবাশ্বার।
জয় বলছেন, হাসিনা নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য দেশে ফিরবেন কিনা, সে বিষয়ে ‘কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম যদি স্থবির হয়ে পড়ে, তাহলে যে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সুযোগ বাড়বে, সে বিষয়ে সবাই একমত। ঢাকাভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের মতে, ‘আগামী দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাসিনা ও তার দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হলে এই প্রেক্ষাপট বদলে যেতে পারে।’
আর ব্যাপক রাজনৈতিকীকরণ হওয়া আমলাতন্ত্র আদতেই সংস্কার বাধাগ্রস্ত করতে চেষ্টা করছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল শহিদুল হক। তিনি বলেন, সংস্কারে বাধা দিতে হেন প্রচেষ্টা নেই, যা এই প্রশাসন করছে না। ‘তারা এই সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আর দৃশ্যমান কোনো উন্নতি না হলে মানুষ ধৈর্য হারাবে।’
আর জয় এই আশাতেই আছেন। বর্তমান ‘আইনবিহীন’ পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) যদি এক বছর বা ১৮ মাস দেশ পরিচালনা করতে চায়, তাহলে ঠিক আছে।’
হাসিনার পতনের পর পুলিশ ও সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক হামলার অভিযোগ উঠলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। ‘কোনো দাঙ্গা হয়নি। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বড় আকারের আক্রমণ দেখিনি’, বলেন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি। তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি।’
এই পরিস্থিতিতে অন্যতম খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ওয়াশিংটন। অন্তর্বর্তী সরকারের আইনগত অবস্থা অস্পষ্ট হওয়ায় মার্কিন সমর্থন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন সমর্থনের গুরুত্ব বোঝা গেছে গত মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে ইউনূসের সাক্ষাতের মাধ্যমে। ‘মার্কিন সমর্থন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর’, বলেন শহিদুল হক।
তবে অচলাবস্থা যত দিন চলতে থাকবে, ততই নতুন বয়ান সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। যদিও জয় তার মায়ের দমন-পীড়নের কিছু ভুল স্বীকার করেন, মৃতের সংখ্যা নিয়েও তর্ক করছেন না। তবে তিনি জোর দিয়ে দাবি করছেন, অন্তত অর্ধেক হত্যাকাণ্ড ‘জঙ্গিরা’ ঘটিয়েছে; যারা সম্ভবত ‘বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা’ থেকে অস্ত্র পেয়েছিল।
তবে জয়ের এই দাবির সপক্ষে বলার মতো কোনো প্রমাণ নেই। মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং আন্দোলন দমনের আদেশ দেওয়ার অসংখ্য ভিডিও রয়েছে।’
দলের নিজ সদস্যদের মধ্যেই সমর্থন ধরে রাখতে পারাটা এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর দলের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ফলে সাধারণ সদস্যদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ‘শেখ হাসিনা যেভাবে চলে গেলেন, তা একদম বিশ্বাসঘাতকতা,’ বলেন মুবাশ্বার।
এছাড়া রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য বলছে, হাসিনার শাসনের ১৫ বছরে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছেন।
৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট জয়ের বাংলাদেশের ব্যাংক হিসাবও ফ্রিজ করেছে। তবে তিনি দুর্নীতির সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের দেখান, টাকা কোথায়? অভিযোগ করা সহজ।’
‘আওয়ামী লীগের উচিত ভুল স্বীকার করা এবং নির্বাচনে লড়ার জন্য একটি গণতান্ত্রিক দল হয়ে ফিরে আসা,’ বলেন মিনাক্ষী গাঙ্গুলি।
আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’ এবং ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’-এর অভিযোগ প্রমাণিত হলে দলটিকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন অনেকেই। এ দাবি জয়ের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। টাইমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে কীভাবে নিষিদ্ধ করবেন? এটি আইনিভাবে সম্ভব নয়।’
এমনকি সংস্কারপন্থিরা এবং বিরোধী দলগুলোও নিশ্চিত নয়, একসময় ব্যাপক তৃণমূল সমর্থন পাওয়া একটি দলকে নিষিদ্ধ করে জাতীয় স্বার্থের কোনো লাভ হবে কিনা। বর্তমানে মূল লক্ষ্য গত কয়েক দশক ধরে চলে আসা প্রবল রাজনৈতিক প্রতিশোধের এই চক্র থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা। তবে কুখ্যাত এবং প্রতিশোধপরায়ণ হাসিনার অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব কিনা, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল শেখ হাসিনাকে কাল্ট চরিত্র হিসেবে দাঁড় করানো। তারা শেখ মুজিবের কন্যার বিকল্প ভাবতেও পারে না।’
শেখ হাসিনার বিকল্প জয় হতে পারবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে জিল্লুর বলেন, ‘তিনি যদি বাংলাদেশের জনগণের নেতা হিসেবে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে না পারেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই।’ জিল্লুরের এই বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গবেষক মুবাশ্বার বলেন, ‘তরুণদের মধ্যে তার (জয়) প্রতি শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ নেই। আর মানুষের মতামত গুরুত্বপূর্ণ।’ আর জয় বলেছেন এ ব্যাপারে এখন চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি তিনি।