নিউজ ডেস্ক:
নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া কিশোর আদনান কবীর খুন হয়েছে উত্তরায়। ঘটনাস্থল তার বাড়ির পাশে, স্কুলের সামনে। মাঠের ভেতরে থাকা কমিউনিটি পুলিশ, আশপাশের মুদিদোকানি, লন্ড্রি, চা-বিক্রেতা, আদনানের স্কুল থেকে দল বেঁধে বের হওয়া ছেলেমেয়েদের কেউ এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো কথা বলছে না। সবাই ভীত, সন্ত্রস্ত। একপর্যায়ে দু-একজন অবশ্য গোপনীয়তা রক্ষার শর্তে মুখ খুলেছেন। বলেছেন, তাঁরা একদল কিশোরের হাতে জিম্মি। এমন ধারার কিশোর এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠরা দেখেননি আর।
গ্যাং কালচার!
অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বে বেশ অনেক বছর আগে যে গ্যাং কালচারের সূত্রপাত, তার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নতুন এই সংস্কৃতির (?)। এই কিশোরেরা সমাজের মধ্যে নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তুলছে। এই সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ—সবকিছু আলাদা। এই সমাজের যাঁরা সদস্য, তাঁদের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। পেশিশক্তি দেখিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখা, দলে-বলে চলা এদের বৈশিষ্ট্য।
ঠিক কবে থেকে নতুন এই ধারার শুরু, সে সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে বছর দুয়েক আগে রাজধানীর মিরপুরে দুই মহল্লার কিশোরদের দ্বন্দ্বে মিরপুর আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহিদুল খুন হয়েছিল। মিরপুর ৬ নম্বরের এ ব্লকের ৬ নম্বর সড়কের কিছু তরুণ-কিশোর ও বেনারসিপল্লির একদল তরুণ-কিশোরের মধ্যে বিরোধ ছিল। এক মহল্লার কিশোর-তরুণদের কেউ অন্য মহল্লায় গেলে হামলার শিকার হতো। এর বাইরে কখনো ধানমন্ডিতে, কখনো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়, আবার কখনো উত্তরায় এমন পাল্টাপাল্টি হানাহানির খবর পাওয়া গেছে। তবে আদনানের মৃত্যুর পর গ্যাং কালচার এবং এর ভয়াবহতার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে।
নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত
এলাকা ঘুরে যতটুকু জানা গেছে, গ্যাংগুলোয় নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোরেরা যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোরেরাও। তারা চলে দলেবলে। উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে এমন একজন শিক্ষার্থী বলছিল, কখনো ডিসকো বয়েজ-উত্তরার পাল্লা ভারী থাকে, কখনো নাইন স্টারের। যাদের যখন প্রাধান্য, তখন তারা বড় ভাই। তারা অন্যায় করলেও চুপ করে থাকতে হবে। নইলে বেয়াদবি করার দায়ে মার খেতে হবে, হয়রানির শিকার হতে হবে, রাস্তায় বেরোলে টিপ্পনি শুনতে হবে।
আরেক ছাত্র জানায়, মেয়েদের নিয়ে খুব ঝামেলা হয়। সহপাঠী, বন্ধু বা বন্ধুর বোনের মতো কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখলে ‘বড় ভাই’ ও তার দলের ছেলেদের হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আসলে নিজেকে বাঁচাতে অনেকেই একটা না একটা দলে ভিড়ে যায়। একেবারে সক্রিয় না হলেও অন্তত একটা যোগাযোগ রাখতে হয়।
উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাহিদ হোসেনও বেশ কয়েকবার এই কিশোরদের মহড়া দিতে দেখেছেন। তিনি বলছিলেন, ‘এই এলাকায় মোটামুটি শিক্ষিত মানুষের বসবাস। কিন্তু ছেলেদের মুখের ভাষা যদি শোনেন। বিচিত্র ভাষা, গালাগালি ছাড়া কথা নেই।’
দায়িত্ব পরিবার আর বড়দের
অবাক হওয়ার মতো তথ্য হলো, স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিশু-কিশোরেরা যে এমন বিপন্ন একটা জীবন কাটাচ্ছে, অভিভাবকেরা সেই খবর রাখেন না। স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষও জানে না। এমনকি জানত না পুলিশও।
আদনান কবীরের বাবা কবীর হোসেন বলেছেন, তিনি ডিসকো বয়েজ-উত্তরা বা নাইন স্টার—কোনো দলের কথাই শোনেননি। কিন্তু ফেসবুকে দল দুটির যে কমন গ্রুপ আছে, সেখানকার ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে কিশোরেরা গাড়ি নিয়ে রাতে বেড়াতে গিয়ে ছবি তুলছে, পার্টি করছে। এমনকি আদনান যেদিন খুন হয়, সেদিনও একদল কিশোরকে একই রঙের পোশাক পরে হকিস্টিক উঁচিয়ে সেলফি তুলতে দেখা গেছে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি এই কিশোরদের ওপর অভিভাবকদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের শিক্ষক শেখ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কিশোরেরা অপরাধে জড়াচ্ছে। এক নম্বর সমস্যা হলো, তারা যা চাইছে তা-ই পাচ্ছে। চাইলেই পাওয়া যায় বলে সন্তানের আবদারের সীমা একপর্যায়ে মাত্রা ছাড়ায়। তারাও সুযোগ কাজে লাগায়।’ মুঠোফোনের সহজলভ্যতা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সমস্যাকে প্রকট করছে বলে মনে করছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও তারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তথ্য ও ছবি আদান-প্রদান করছে, মারপিটের নির্দেশ দিচ্ছে অনলাইন বার্তায়।
পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত, দুই দলের দ্বন্দ্বে আদনান খুন হয়েছে। উত্তরা অঞ্চলের উপকমিশনার বিধান ত্রিপুরা তা-ই বলছেন। তাঁরা বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে এলাকার সমস্যা জানা ও সমাধানের চেষ্টা করে থাকেন। এখন থেকে উঠানবৈঠকগুলোয় অভিভাবক ও স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন। তবে তিনি মনে করেন, মূল দায়িত্ব পরিবারের।
এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদেরও দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক শেখ হাফিজুর রহমান। শিশু-কিশোরদের গঠনমূলক বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত করা না গেলে তারা সহিংস কাজে জড়াবে।