বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫
বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫

ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার

জাতীয় ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে এবার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ সংলাপে দেশের শীর্ষ ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে চলমান নানা ইস্যু এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়।

সংলাপে প্রধান উপদেষ্টার পাশাপাশি ধর্মীয় নেতারা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এসময় দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। একইসঙ্গে কোনো প্রোপাগান্ডার ফাঁদে না পড়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ বজায় রাখতে সবাই একযোগে কাজ করবেন বলে জানান।

মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, গারোসহ বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের প্রায় অর্ধশত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে হওয়া বৈঠকের শুরুতেই অধ্যাপক ইউনূস উপস্থিত সবার উদ্দেশে বলেন, আমরা একটা পরিবার। আমাদের নানা মত থাকবে, নানা ধর্ম থাকবে, কিন্তু আমরা সবাই বাংলাদেশি, আমরা একই পরিবারের সদস্য। শত পার্থক্য সত্ত্বেও আমরা কেউ কারও শত্রু নই। জাতীয়তার প্রশ্নে আমরা সবাই এক।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শুনতে আরম্ভ করলাম সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চলছে। আমাদের সবার সমান অধিকার। বলার অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার-সেটা সংবিধান থেকেই এসেছে। সবার জন্য এ অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। হাজার হাজার পূজামন্ডপে এবার উৎসবের সঙ্গে দুর্গাপূজা পালিত হয়েছে। তারপরও বিদেশি কিছু মিডিয়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে বলে প্রচার চালানো হচ্ছে। আমি খোঁজ নিচ্ছি। সবাই বলছে এমন কিছু হচ্ছে না। তাহলে কোনটা সত্য? আমি আপনাদের থেকে সঠিক তথ্য জানতে চাই। কেউ অপরাধ করলে অবশ্যই তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে।

ধর্মীয় নেতারা বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার পেছনে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের হাত থাকতে পারে। এ ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তারা সবাই মিলে এগুলো প্রতিহত করবেন।

সংলাপ শেষে ইসলামী চিন্তাবিদ শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, আমাদের মধ্যে চমৎকার ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রয়েছে। বাংলাদেশের আলেম-ওলামারা অত্যন্ত দায়িত্বশীল। যে কারণে প্রকাশ্যে আইনজীবী আলিফকে হত্যার পরও বাংলাদেশের মুসলমানরা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। আমরা সম্প্রীতির যে উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করেছি তা পৃথিবীতে বিরল।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে প্রত্যেকেই একই সুরে কথা বলেছেন যে, আমরা কোনো প্রোপাগান্ডায় পা না দিয়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ বজায় রাখতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করব। এ দেশের সংখ্যালঘুরা নিরাপদে আছেন, নিরাপদে থাকবেন। এজন্য সরকার যেমন কাজ করছে, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দও কাজ করে যাবে। যারা আমাদের মধ্যে ফাটল দেখাতে চেষ্টা করছে, তাদের মিথ্যা প্রপাগান্ডায় বিশ্ববাসী যেন বিভ্রান্ত না হয়।

রমনা শ্রীশ্রী হরিচাঁদ মন্দিরের ধর্মীয় সহসম্পাদক অবিনাশ মিত্র বলেন, সংলাপে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরুরা উপস্থিত হয়েছেন। এখানে আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। তবে বিভেদ তো হচ্ছে। আমাদের মধ্যে ঢুকে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে কেউ তার স্বার্থ হাসিল করতে চাইছে। এটা আমরা চাই না। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এসব হটকারিদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে। বাইরের রাষ্ট্র হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের দোহাই দিয়ে কিছু হাসিল করে নেবে সেটা আমরা চাই না।

রমনা সেন্ট মেরীজ ক্যাথিড্রালের প্রধান পুরোহিত ফাদার আলবার্ট রোজারিও বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশ স্পর্শকাতর সময় পার করছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একজন আইনজীবী মারা গেছে, ভারতের ছোটখাটো মিডিয়াগুলোতে উসকানিমূলক কথা বলে যাচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশের মানুষ সম্প্রীতি ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এতেই প্রমাণ হয় এ দেশের মানুষ কতটা শান্তিপ্রিয়।

বাংলাদেশ বুদ্ধিষ্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয় বলেন, আমরা বাংলাদেশে ভালো আছি। অন্য দেশের মিডিয়া কী প্রচার করল তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবেদন জানিয়েছি, বাঙালি জাতির যে সম্প্রীতির ঐতিহ্য সেটা যেন বজায় থাকে। তিনি আশ্বস্ত করেছেন।

গারো পুরোহিত জনসন মৃ কামাল বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি/ যেসব মিডিয়া আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের আমরা সবাই মিলে প্রতিহত করব।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব হযরত মাওলানা সাজেদুর রহমান বলেন, আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। সবাই ভাই ভাই। বেশ কয়েকজন অমুসলিম ভাই সংলাপে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে না। এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই পাশের দেশে। বাংলাদেশে একজন মুসলিম আইনজীবীকে অমুসলিম কর্তৃক প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করার পরও বাংলাদেশ শান্ত। ফরিদপুরের মধুখালীতে হিন্দু সম্প্রদায় কর্তৃক দুজন হাফেজ ছাত্রকে হত্যার পরও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। আমরা অমুসলিম ভাইদের পাহারা দেই। তাদের মন্দিরকে পাহারা দেই। দেশের স্বার্থে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। যেই দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে, ঐক্যবদ্ধভাবে দমন করা হবে।

বাংলাদেশ বুদ্ধিষ্ট ফেডারেশনের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, একটা আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি সম্মেলন আয়োজনের কথা বলেছি। সেখানে সারা পৃথিবী থেকে সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ আসবে। বিশ্ববাসী দেখুক বাংলাদেশ শান্তি-সম্প্রীতির দেশ।

এরপর সরকারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোথাও নিপীড়ন হয় না সেটা বলা যাবে না। তবে কোথাও যদি হিন্দু বা অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন হয়, সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেবে। এই দেশ সবার। কোথাও নিপীড়নের ঘটনা দেখলে গণমাধ্যমে তা তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি।

Similar Articles

Advertismentspot_img

Most Popular