১২ সিটি করপোরেশনের মেয়র, ৬০ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সারা দেশের সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস য়ারম্যাচেন, নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। স্থানীয় সরকারের এই চার স্তরে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮৭৬ জন জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করা হলো।
রোববার (১৮ আগস্ট) স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত তিনটি পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ ছাড়া গতকাল সোমবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করেছে সরকার।
৬০ জন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ৪৯৩ জন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়েছে। সারা দেশের উপজেলা পরিষদের ৯৮৮ জন ভাইস চেয়ারম্যানকে অপসারণ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর মধ্যে ৪৯৪ জন পুরুষ এবং ৪৯৪ জন নারী। গতকাল স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের স্থলে জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের জায়গায় দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)।
এতে বলা হয়েছে, উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ এবং স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ প্রয়োগ করে পৌরসভার মেয়র, জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিজ নিজ পদ থেকে অপসারণ করা হলো।
এর মধ্যে মৃত্যুজনিত কারণে নাটোর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে ৬১টি জেলা পরিষদের শূন্য পদে প্রশাসকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে সাতটি পৌরসভার প্রশাসককে।
এর আগে গত শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এবং ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন করে। পরে এগুলো অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়।ওই সংশোধনী অনুযায়ী বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার যদি জনস্বার্থে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করে, তাহলে কোনো সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরকে অপসারণ করতে পারবে।
একইভাবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদেরও অপসারণের ক্ষমতা থাকবে সরকারের। একই সঙ্গে সরকার এসব পদে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে।
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এমনিতেই অনেক বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হয়। এখন সরকার যেহেতু দায়িত্ব দিয়েছে, সেহেতু সেটা পালন করব। ’
কসবা পৌর প্রশাসকের দায়িত্ব পাওয়া অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) জেসমিন সুলতানা বলেন, ‘আমি সরকারের কর্মচারী। সরকার যখন যে দায়িত্ব দেবে, সেটা পবিত্র মনে করে পালন করব। ’
১২ সিটি করপোরেশনের মেয়র অপসারণ:
ঢাকার দুই সিটিসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এতে বলা হয়, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর ধারা ১৩-এর ক অনুযায়ী ওই সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের নিজ নিজ পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে।
একই সময় ওই ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রের শূন্য পদে ১২ জন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তিনজন অতিরিক্ত সচিবকে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালককে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ সিটির মেয়র পদে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নিজ নিজ বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারদের।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সিটি করপোরেশন আইনের ২৫(ক)-এর উপধারা (১) অনুযায়ী পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাঁদের প্রশাসক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নবনিযুক্ত প্রশাসক এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মহ. শের আলী বলেন, ‘সরকার দায়িত্ব দিয়েছে, তা পালন করব। নাগরিক সেবায় শৃঙ্খলা ফেরানোই আমার প্রথম কাজ। ’ কাউন্সিলরদের পদ থাকবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা স্থানীয় সরকার বিভাগ সিদ্ধান্ত নেবে।
গতকাল নিজ দপ্তরে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করা হলেও কাউন্সিলরদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
হাসান আরিফ বলেন, প্রশাসক থাকলে কাউন্সিলররা দায়িত্ব পালন করবেন কি করবেন না, সেটা এখন তাঁদের ব্যাপার। মূল কথা হচ্ছে, মেয়র এবং চেয়ারম্যানের জায়গায় প্রশাসক দায়িত্ব পালন করবেন। আমরা ধারাবাহিকভাবে কাজ করব। এখানে মার মার কাট কাটের কোনো বিষয় নেই। এটি সমগ্র স্থানীয় সরকারকে পরিচ্ছন্ন করার একটি প্রচেষ্টা।
সরকারের আদেশের পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম। গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে গিয়ে দায়িত্ব বুঝে নেন বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন তিনি। মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশনে আজ গিয়ে সবার সঙ্গে বৈঠক করব। বৈঠক থেকে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে করণীয় ঠিক করব৷ তারপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব কাজ করা দরকার সেগুলো করা হবে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর। গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নগর ভবনের সচিব দপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করে দায়িত্বভার বুঝে নেন তিনি। এরপর নগর ভবনের প্রথম থেকে দশম তলা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কক্ষগুলো পরিদর্শন করেন। আজ মঙ্গলবার তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
এ সময় রাসিক প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর আমার প্রথম কাজ হচ্ছে সিটি করপোরেশনের মৌলিক যে কাজগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে সচল করা, যাতে নাগরিক ভোগান্তি না হয়। পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি কাজ করা হবে। কাল করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বাকি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হবে।
এ সময় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এ বি এম শরীফ উদ্দিন, সচিব মো. মোবারক হোসেন, প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সাদিয়া আফরিন, বাজেট কাম হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম খান, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবু সাহেল মো. নূর-ঈ-সাঈদ, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এফ এ এম আঞ্জুমান আরা বেগম, নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আহম্মেদ আল মঈন পরাগসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।