নিউজ ডেস্ক:
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার খবরে সরগরম চারদিক। তবে সংশ্নিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত দুর্নীতির মাত্রা আরও বেশি। ভিন্ন কৌশলে আরও লক্ষাধিক টন কয়লা অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়েছে বলে সংশ্নিষ্টরা বলছেন।
সেটা কীভাবে? সংশ্নিষ্টরা জানান, কয়লা খনির ভূগর্ভ থেকে অনবরত পাম্পের মাধ্যমে পানি নিস্কাশন করা হয়। এই পানি এসে জমা হয় কয়লা খনির ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে। সেখানে কয়লার ডাস্ট (ক্ষুদ্রাকৃতির কয়লা) জমা হয়। এই কয়লা পুনরায় শুকিয়ে আবার জমা করা হয় কোল ইয়ার্ডে। তবে যে পরিমাণ ডাস্ট কয়লা কোল ইয়ার্ডে জমা হয় তার কোনো হিসাব রাখা হয় না। হিসাবের বাইরে থাকা এই কয়লা অবৈধভাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
কয়লা ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন জানান, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে যে কয়লা জমা হয় তা ঠিকাদারের মাধ্যমে শুকিয়ে কোল ইয়ার্ডে জমা করা হয়। এখানে বছরে প্রায় ১৬ থেকে ২০ হাজার টন কয়লা উৎপাদন করা হয়। কিন্তু এই হিসাব কাগজে-কলমে রাখা হয় না। কোল ইয়ার্ড থেকে অবৈধভাবে এসব কয়লা বিক্রি করেন কর্মকর্তারা।
তিনি বলেন, বর্তমানে অভিযোগ করা হচ্ছে কয়লা চুরি হয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার টন। তবে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে জমা হওয়া কয়লার হিসাব কষলে দেখা যাবে এটার পরিমাণ অনেক বেশি।
একই কথা জানান কয়লা খনির ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে জমা হওয়া কয়লা শুকিয়ে সরবরাহে নিয়োজিত সাবেক ঠিকাদার মিজানুর রহমান। তিনি জানান, গত ৭-৮ বছর ধরে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থেকে কয়লা জমা করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে জমা করা ডাস্ট কয়লার পরিমাণ সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ টন।
তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী শাখার সাবেক সদস্য সচিব এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ফুলবাড়ী উপজেলা শাখার সম্পাদক এসএম নুরুজ্জামান জানান, কয়লা খনিতে যে দুর্নীতি হয়েছে তার প্রধান ও অন্যতম কারণ ডিও (ডিমান্ড অর্ডার) বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের সঙ্গে মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মকর্তারা জড়িত। তারা বিভিন্নজনের নামে কয়লার ডিও দেন। ডিওতে কয়লার যে পরিমাণ উল্লেখ থাকে কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ও কমিশন বাণিজ্যের ফলে তার চেয়ে অনেক বেশি দেওয়া হয়। কমিশন বাণিজ্যের অর্থ সবার মাঝেই বণ্টন হয় বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
কয়লা ব্যবসায়ী মশিউর রহমান বুলবুল জানান, কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে কিছু গ্রাহক কাগজে যা রয়েছে তার চেয়ে বেশি কয়লা গ্রহণ করেন। এতে বাস্তবে কয়লার মজুদ ঠিক থাকে না। এ কারণে বর্তমানে কাগজে কয়লা থাকলেও বাস্তবে নেই। খতিয়ে দেখা হলে এবং অধিকতর তদন্ত হলে আরও অনেক দুর্নীতিই বেরিয়ে আসবে।
এ ব্যাপারে কথা বলতে কয়লা খনির ভেতরে প্রবেশ করতে চাওয়া হলেও প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সদ্য বরখাস্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদের মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
গতকাল বৃহস্পতিবার কয়লা খনিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গেটে আগের মতোই নিরাপত্তা প্রহরীরা দাঁড়িয়ে। প্রবেশের কোনো অনুমতি নেই। তবে সাংবাদিকদের দেখে উৎসুক অনেকেই এগিয়ে আসেন। তাদের একজন রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, খনিতে কয়লা চুরি নতুন নয় বা একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই কয়লা চুরি করে আসছেন কর্মকর্তারা। দুর্নীতিবাজদের একজন আবুল কাশেম প্রধানীয়া। তিনিই মূলত নাটের গুরু। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করার সুবাধে তিনি বিভিন্ন লোকের সঙ্গে আঁতাত করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। জন্মস্থান চাঁদপুরে হলেও ঢাকার কেরানীগঞ্জে বহুতল ভবন করেছেন। পেট্রোল পাম্প আছে স্ত্রী ও শাশুড়ির নামে। এছাড়াও পরীবাগে রয়েছে বাড়ি। একইভাবে মাদারীপুরে বাড়ি রয়েছে মাসুদুর রহমান হাওলাদার নামে আরেকজনের। তার ৩-৪টি মাইক্রোবাস রয়েছে, যার প্রতিটির দাম অর্ধকোটি টাকারও বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, ২০১৭ সালে খনি থেকে ৩০০ টন কয়লা চুরি হয়েছিল। পরে বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে খনির কর্মকর্তারা রাতারাতি সেই কয়লার টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে সমন্বয় করেন। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন অর্থ ও হিসাব শাখার মহাব্যবস্থাপক গোপাল চন্দ্র সাহা। সেই সময়ে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও পরে আবার তিনি বহাল হন। কয়লা খনি থেকে প্রতি বছরই ইটভাটা মালিকদের কাছে ১০০ টন করে কয়লা বিক্রি করা হয়। এই বিক্রিতেও দুর্নীতি হয়। কাউকে হাজার হাজার টন কয়লা দেওয়া হয়। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এটি হয়েছে বলে দাবি তার।
সম্প্রতি বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশের পর খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদকে প্রত্যাহার, কোম্পানি সচিব ও মহাব্যবস্থাপক আবুল কাশেম প্রধানীয়াকে বদলী ও দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে এই ৪ কর্মকর্তাসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।