সড়ক, রেল ও নৌ-পথে সম্মিলিতভাবে ৩৩৭টি দুর্ঘটনায় জন ৪৮৮ নিহত ও ১৮৫০ জন আহত হয়েছে।
বুধবার (২৬ জুন) সকালে নগরীর বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ-২০২৪ প্রকাশকালে এই তথ্য তুলে ধরেন।
সংগঠনটির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল প্রতি বছরের ন্যায় এবারও প্রতিবেদনটি তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর ঈদকে কেন্দ্র করে সড়ক দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। সংগঠনটি ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানির বিষয়টি দীর্ঘ এক দশক ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছে।
এবারের ঈদে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও পরিবহন ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষের কম যাতায়াত হয়েছে। বর্তমান সরকারের বিগত ১৫ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে দেশের সড়ক মহাসড়কের অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো ছিলো।
ঈদের আগে ৩ দিন সরকারি ছুটি থাকায় যাত্রী চাপ কিছুটা ভাগ হয়েছে। দেশে ঈদযাত্রায় মোট যাতায়াতের প্রায় ৭ থেকে ৯ শতাংশ মোটরসাইকেলে হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। তবুও ছোট ছোট যানবাহন বিশেষ করে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ব্যাপকহারে বাড়ার কারণে কোন কোন সড়কে এসব যানবাহন হঠাৎ করে জাতীয় মহাসড়কে উঠে আসার কারণে, কোন কোন জাতীয় মহাসড়কে এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এছাড়াও সড়কে চাঁদাবাজি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহনসহ নানা কারনে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে। একই সাথে সড়কে ভাড়া নৈরাজ্যের কারনে নিম্ন আয়ের লোকজন ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও খোলা ট্রাকে যাতায়াতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ১০ জুন থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ২৪ জুন পর্যন্ত বিগত ১৫ দিনে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যমতে, ৩০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন নিহত ৭৬২ জন আহত হয়েছে। অপরদিকে, ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী ঈদের আগে পরে ১৪ দিনে ১০৭৮ জন সড়ক দুর্ঘটনায় রোগী ভর্তি হয়েছে। যার মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাত বা পা ভেঙে ভর্তি রোগী ৪৭৮ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসেব বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীর ১৫ শতাংশ হাসপাতালে অথবা বাসায় চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যায়। সেই হিসেবে এবারের ঈদে ৪৫৮ জন নিহত ও ১৮৪০ জন আহত হয়েছে। দেশে প্রায় ৯ হাজার সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে ঈদের আগে ও পরে ১৫ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত কতজন রোগী ভর্তি হয়েছে তা জানানোর জন্য বিআরটিএ’র কাছে দাবি জানাচ্ছি।
বিগত ২০২৩ সালের ঈদুল আজহার যাতায়াতের সাথে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ১১.৫৫ শতাংশ, প্রাণহানি ৫৩.১৭ শতাংশ, আহত ২৩৮.২৩ শতাংশ বেড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ১৩২ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩০ জন নিহত ও ৫৯৯ জন আহত হয়েছে। যা মোট দুর্ঘটনার ৪২.৭১ শতাংশ, মোট নিহতের ২৮.৩৮ শতাংশ, মোট আহতের ৩২.৫৫ শতাংশ।
এই সময় সড়কে দুর্ঘটনায় ৫১ জন চালক, ১১ জন পরিবহন শ্রমিক, ৪৮ জন পথচারী, ৬১ জন নারী, ২৪ জন শিশু, ১৪ জন শিক্ষার্থী, একজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য (০১ সেনাবাহিনী), ৩ জন শিক্ষক, ০২ জন মুক্তিযোদ্ধা, ৩ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নিহত হওয়ার পরিচয় মিলেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সদস্যরা বহুল প্রচারিত ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক ও অনলাইন দৈনিক এ প্রকাশিত সংবাদ মনিটরিং করে প্রতি বছর ঈদযাত্রায় এ প্রতিবেদন তৈরি করে আসছে।
সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ২৮.৩৪ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২১.৩৫ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি, ১৪.৫৭ শতাংশ ব্যাটারিরিক্সা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল, ১৩.৭৭ শতাংশ বাস, ৯.৯৮ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ, ৫.৭৮ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা ও ৬.১৮ শতাংশ সিএনজি অটোরিকশা এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।
সংঘটিত দুর্ঘটনার ২৫.২৪ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৫১.১৩ শতাংশ গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ২১.০৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা, ০.৩২ শতাংশ ট্রেনের সাথে যানবাহনের সংঘর্ষের ঘটনা, চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে ০.৬৪ শতাংশ এবং ১.৬১ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাতকারণে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৪০.১২ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২২.৯৭ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৩১.৩৯ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। ০.৩২ শতাংশ রেলক্রসিং ছাড়াও সারাদেশে সংগঠিত মোট দুর্ঘটনার ৪.৮৫ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে ও ০.৩২ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে সংগঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদাসীন, তাই ছোট যানবাহন বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। গণমাধ্যমে এখন সংঘটিত দুর্ঘটনার সঠিক চিত্র আসে না। এবারের ঈদে আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে সারাদেশের হতাহতের সংখ্যা পেয়েছি মাত্র ১০৯৮ জন। অথচ ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ১৪ দিনে ভর্তি হয়েছে ১০৭৮ জন।
সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি ৯ হাজার হাসপাতালে চিত্র অনেক ভয়াবহ। নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হলেও কেন সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না, সরকারিভাবে তার অডিট হওয়া দরকার। সড়ক নিরাপত্তায় কোন গবেষণা নেই, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রকৃত দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিত হচ্ছে না, সড়কে ক্রুটির জন্য কোনো প্রকৌশলী জবাবদিহি করছে না, তদন্ত দুর্বলতা, আইনের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতরা আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে সরকারের সদিচ্ছার শর্তেও সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। তিনি এসময় স্মার্ট পদ্ধতিতে সড়ক আইন প্রয়োগের দাবি জানান।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সংগঠনের সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল, বিশিষ্ট সমাজকর্মী মোহাম্মদ মহসিন প্রমুখ।
এবার ঈদে সড়ক দুর্ঘটনার কারণসমূহ:
১. ঈদের ০৩ দিন আগে থেকে জাতীয় মহাসড়কে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য।
২. দেশের সড়ক মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক ও অটোরিকশা অবাধে চলাচল।
৩. অতিরিক্ত গতি, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা।
৪. উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন।
৫. অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন।
৬. দ্রুতগতির বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ধীরগতির পশুবাহী ট্রাক-পিকআপ চলাচল।
৭. সড়কের পাশে পশুরহাট।
দুর্ঘটনার প্রতিরোধে সুপারিশসমূহ:
১. মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ইজিবাইকের মত ছোট ছোট যানবাহন আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা।
২. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, ডিজিটাল পদ্ধতিতে যানবাহনের ফিটনেস প্রদান।
৩. ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা।
৪. সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা।
৫. সড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং অঙ্কন ও স্থাপন করা। রাতের বেলায় ব্যাপক আলোক সজ্জা ব্যবস্থা করা।
৬. স্মার্ট পদ্ধতিতে সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগ করা।
৭. ঈদের আগে ০৩ দিন আগে থেকে জাতীয় মহাসড়কে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা।
৮. গণপরিবহন বিকশিত করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা।