নিউজ ডেস্ক:
মহান আল্লাহ যেসব অগণিত নেয়ামতের মাধ্যমে মানব জাতিকে ধন্য করেছেন, তার মধ্যে স্বাধীনতা এক বিশেষ নেয়ামত। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার যে কত বড় মাপের, তা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধরাই কেবল অনুধাবন করতে পারেন। তাই স্বাধীনতাকে খর্ব করার অধিকার কারো নেই। এ অধিকার খর্ব করা যেমন মানবাধিকার পরিপন্থী; তেমনি মহান আল্লাহর আইনের বিরোধীও বটে।
ইসলাম গতানুগতিক কোনো স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে আসেনি, ইসলাম মানবতার সামগ্রিক জীবনে মুক্তি, সাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার বাস্তব কর্মসূচি দিয়ে মানুষকে সৎ পথে চলার দিকনির্দেশনা দিতে এসেছে। ইসলাম মানব জীবনে ধর্মীয় স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি দিয়ে ধন্য করেছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতা : ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি মৌলিক স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা রক্ষায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। তাই অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঈমান বা বিশ্বাস গ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে কোনোরূপ জবরদস্তি ইসলামে বৈধ নয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই ঈমান আনত। তবে কি তুমি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষের উপর জবরদস্তি করবে?’ (সূরা ইউনুস : ৯৯)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘দীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই’ (সূরা বাকারা : ২৫৬)। ইসলামে অন্য ধর্মের উপাস্যকে গালি দিতে নিষেধ করে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে, তাদেরকে তোমরা গালি দিও না’ (সূরা আনয়াম : ১০৮)।
ইসলাম অমুসলিমদের শুধু তাদের ধর্ম পালনে স্বাধীনতা প্রদান করে না, বরং ইসলামি আইন অমুসলিমদের তাদের কার্যক্রম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারেও সাহায্য করে থাকে।
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক মর্গান রবার্টসন লিখেছেন, ‘অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সহনশীলতার ঈর্ষান্বিত দাবিদার এবং দাবি করার উপযুক্ত একমাত্র মুসলিমরাই, তাদের ধর্ম পালনের মাধ্যমে এমনকি যখন তারা তাদের ধর্মকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য খোলা তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন বিজিত স্থানের লোকদেরকে তাদের ধর্মমত পরিত্যাগ করার জন্য বাধ্য না করে তাদের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেন।’
চিন্তার স্বাধীনতা : ইসলাম মানুষকে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বাধীনতা দিয়ে মানব অস্তিত্বে স্বাধীনতার বীজ বপন করে দিয়েছে। ইসলাম মানুষকে সঠিক পথ প্রাপ্তির জন্য আল কুরআন নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘তবে কি তারা কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে না? এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট হতে আসত, তবে তারা তাতে অনেক অসঙ্গতি পেত’ (সূরা নিসা : ৮২)।
বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রসরতা ও মুক্তচিন্তাকে ইসলাম সাধুবাদ জানায়। আল্লাহ চিন্তাশীল মানুষদের ভালোবাসেন। যারা চিন্তা করে না, তাদের ভর্ৎসনা করে আল্লাহ বলেন, ‘আমি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানবকে সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে, কিন্তু তারা দেখে না’ (সূরা আ’রাফ : ১৭৯)।
মূলত ইসলাম যুক্তি, বুদ্ধি-বিবেচনার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে, দিয়েছে যথাযথ মর্যাদা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি বোধসম্পন্ন লোকদের নিকট নিদর্শনাবলি বিবৃত করি’ (সূরা রূম : ২৮)।
এ আয়াতের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, বোধসম্পন্ন লোক তারাই যারা বিবেক বা চিন্তাশক্তির মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করতে পারে। তাই আল কুরআনে চিন্তা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিবেক কাজে লাগানোর কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! বলুন, আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করো’ (সূরা ইউনুছ : ১০১)।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা : মত প্রকাশের অধিকার মানুষের জন্মগত। ইসলাম প্রতিটি নাগরিককে জাতীয়, আঞ্চলিক এমনকি ব্যক্তিগত বিষয়েও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। এ অধিকার উপেক্ষা করে যুগে যুগে কিছু পাপাচারী স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে যেয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে পরোক্ষভাবে নাগরিক জীবনকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে দেশে দেশে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ইসলাম শুধু পুরুষদের তার মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়নি, নারীদেরও তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। মদিনা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে মহানবী সা: নারীর মতামত প্রদানকে আইনগত ভিত্তি দান করেন। তিনি পুরুষদের ন্যায় নারীদের থেকেও বিভিন্ন বিষয়ে অঙ্গীকার গ্রহণ করতেন। তার এ সুন্নতের ওপর আমল করে খুলাফায়ে রাশেদিন তাঁদের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে নারীদের মতামতের গুরুত্ব নিশ্চিত করেন।
একদিন মসজিদে খুতবা দানকালে হজরত উমর রা: বেশি পরিমাণ দেনমোহর প্রদানে নিরুৎসাহিত করেন। এ ভাষণ শুনে এক মহিলা প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আল্লাহ তো আমাদের দিয়েছেন আর আপনি কেড়ে নিচ্ছেন? আপনি কি জানেন না’, আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা স্থির কর এবং তাদের একজনকে অগাধ অর্থও দিয়ে থাক, তবুও তা হতে কিছুই প্রতিগ্রহণ করো না’ (সূরা নিসা : ২০)। মহিলার এ কথা শুনে উমর রা: সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বললেন, একজন নারী সত্য বলেছে, উমর ভুল করেছে।’ এটাই ইসলাম।
ইসলামে স্বাধীনতার মর্ম : ইসলাম রক্তপাত, হানাহানি, মারামারি, হত্যা অথবা ইসলাম গ্রহণে জবরদস্তির অনুমোদন দেয় না, কিন্তু অন্যায়, হত্যা, স্বাধীনতা হরণ প্রতিরোধে যুদ্ধ করতেও নির্দেশ দেয়। নিজ দেশকে পরাধীনতামুক্ত রাখতে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগে নির্র্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কেননা কোনো জুলুমকেই প্রশ্রয় দেয় না ইসলাম। জালিমদের খপ্পর থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে লড়াই করার তাগিদ দিয়ে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কী হলো যে, তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী এবং শিশুদের জন্য যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এই জনপদ- যার অধিপতি জালিম, তার থেকে আমাদেরকে অন্যত্র নিয়ে যাও, তোমার নিকট থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট থেকে কাউকেও আমাদের সহায় কর’ (সূরা নিসা : ৭৫)।
জুলুম ও শোষণমুক্ত, আল্লাহদ্রোহী মানসিকতামুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে কল্যাণরাষ্ট্রে অক্ষুণ্ন রাখতে নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কেননা স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা অধিক কঠিন। তাই তো আল্লাহ আদেশ করেছেন, ‘তোমরা সর্বদাই তোমাদের শত্রুদের প্রতিহত করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে সাবধান থাকবে। এই প্রস্তুতি দ্বারা তোমরা তোমাদের এবং আল্লাহর দুশমনদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখবে’ (সূরা আনফাল : ৬০)।
স্বাধীনতার সীমারেখা : ইসলাম স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও সে স্বাধীনতা বল্গাহীন স্বাধীনতা নয়। সে স্বাধীনতা কিছু বিধিনিষেধ দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত। ইসলামে স্বাধীনতা হচ্ছে নিজেকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করা। আল্লাহ বলছেন, ‘বল, আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই
উদ্দেশ্যে’ (সূরা আনয়াম : ১৬২)। ইসলাম মানুষকে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে, কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরতান্ত্রিকতাকে মোটেও প্রশ্রয় দেয়নি। দলের ঊর্ধ্বে ওঠে ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, দুর্বল-সবল সকলের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি আল্লাহ তোমাকে যা জানিয়েছেন সে অনুসারে মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা কর’ (সূরা নিসা : ১০৫)। ইসলাম মানুষকে বৈধভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণ করার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু জেনা-ব্যভিচারকে নিষেধ করেছে। বলা হয়েছে, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, নিশ্চয় এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (সূরা বনি ঈসরাইল : ৩২)। ইসলাম পোশাক
পরিধানের স্বাধীনতা দিয়েছে, অশালীন পোশাক পরিধানে বারণ করেছে। হজরত উমর রা: বলেন, ‘নারীদের এমন আঁটসাঁট পোশাক পড়তে দিওনা, যাতে শরীরের গঠন পরিষ্ফুটিত হয়ে উঠে।’ ইসলাম মানুষকে পানাহারের স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু অপচয় করতে নিষেধ করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আহার করবে ও পানাহার করবে, কিন্তু অপচয় করবে না’ (সূরা আ’রাফ : ৩১)। ইসলাম মানুষকে অর্থ উপার্জনের স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু অবৈধ পথ পরিহারের নির্দেশ দিয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে’ (সূরা জুমু’আ : ১০)। ইসলাম বৈধভাবে অর্থ ভোগের স্বাধীনতা দিলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধে ধনীদের সম্পদে একচ্ছত্র ভোগাধিকার দেয়নি। বলা হয়েছে, ‘তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক’ (সূরা জারিয়াত : ১৯)। অর্থ উপার্জনে ইসলাম ব্যবসাকে বৈধ করলেও সুদকে চিরতরে হারাম ঘোষণা করেছে। অর্থ উপার্জনের তাগিদ দিয়ে অন্যায় পথ অবলম্বন নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)।
ইসলাম শোষণমুক্তির কথা বলে। মানুষের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে মানুষকে আল্লাহর কাছে সমর্পিত হতে শিক্ষা দেয়। কাজেই মুসলমানের প্রকৃত মুক্তি ও সফলতা হলো পরকালীন মুক্তি ও সাফল্য। কোনো কাজে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য না হওয়া পর্যন্তই মুসলমানদের স্বাধীনতা রয়েছে।
ইসলাম স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। বস্তুত দেশপ্রেম ও জাতিপ্রেমের কোনো বিকল্প নেই। দেশের প্রচলিত (ইসলাম বিরোধী নয় এমন) দেশীয় পণ্যকে প্রাধান্য দেয়া, জাতীয় সম্পদের সুরক্ষা, অপচয় রোধ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ইত্যাদি বিষয়গুলো হলো দেশপ্রেমের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
এসব বিষয়ের প্রতি প্রতিটি নাগরিককে যেমন সজাগ থাকতে হবে, তেমনি শাসকদেরও এর প্রতি যত্নশীল হতে হবে।
শেষ কথা : স্বাধীনতা একটি ব্যাপক প্রত্যয়, যার প্রকৃতি অবর্ণনীয়। স্বাধীনতাই মানুষের অস্তিত্বে লালিত সুপ্ত প্রতিভা ও শক্তিকে ক্রমাগত সমৃদ্ধির পথে বিকশিত করতে সহায়তা করে। প্রত্যেক মানুষ চায় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে। এ ব্যাপারে ইসলাম মানুষকে পূর্ণাঙ্গ এখতিয়ার দিয়েছে। ইসলাম ধর্মে স্বাধীনতা মূলত তখনই অর্থবহ হবে, যখন প্রতিটি ক্ষেত্র হতেই দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ, লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনের অপপ্রয়োগ, জবরদখল, সুদঘুষ, ঋণখেলাপি, জেনা-ব্যভিচার, হত্যা, গুম ইত্যাদি অপশাসন হতে মুক্ত হবে।
প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিটি অপশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সরকারের দায়িত্ব হবে কোনোভাবেই যেন অপশাসন মাথচাড়া দিয়ে না ওঠে। এবারের স্বাধীনতা দিবসে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।