নিউজ ডেস্ক:
ন্যাশনাল আইডি কার্ড অনুযায়ী বয়স তার আশি। অবশ্য আশি বছরে তার আপত্তি রয়েছে । তিনি মনে করেন তার বয়স আরও বেশি । কম করে পঁচাশি। এই বয়সেও অভিনয় করে চলেছেন পঞ্চগড়ের পালাটিয়া শিল্পী পুহাতু বর্মণ । এখনো দুর্দান্ত প্রতাপে অভিনয় করছেন তিনি। হাটে মাঠে ঘাটে তার অভিনয় দেখার জন্য জেগে জেগে রাত পার করে দেয় পঞ্চগড়ের হাজারও গ্রামীন জনতা।
পুহাতু বর্মণের বাবা দিনকাটু ছিলেন পালাটিয়া শিল্পী। তারই হাত ধরে মাত্র সাত বছর বয়সে ছুকরির (ছেলেরা মেয়ে সেজে নর্তকী) অভিনয় জীবন শুরু হয় পুহাতু বর্মণের । এর পর গুরু ভাদ্রু খলিফার কাছে শিখেন অনেক কিছু। ‘৪৭ এর দেশ ভাগের সময় বাবা-মায়ের হাত ধরে পাড়ি জমান ভারতে। কিছু দিনের মধ্যে সেখানে পেটের পিড়ায় আক্রান্ত হলে বাবা-মা সহ আবার ফিরে আসেন দেশে। এর পর থেকে এই এলাকায় পালাটিয়া গানের অপরিহার্য শিল্পী হয়ে ওঠেন তিনি । গান তার পেশা আর নেশায় পরিণত হয়।
সাগর ভাসা নামের একটি পালায় প্রথম নারী চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন তিনি। এরপর একে একে প্রায় শতাধিক পালায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন । গ্রাম গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। হাজারো রাত কাটিয়েছেন অভিনয় করে। সত্যপীর, বাহরাম বাদশা গজরা বিবি, বিন্দুমতি অমলকুমার, টেপুয়া জমিদার, সাইকেলসরি হেন্ডেলু ফাতরা, ভাঁকাবেচি, জাতেরমেয়ে, বেদের মেয়ে জোসনা সহ অসংখ্য আঞ্চলিক পালায় অভিনয় করেছেন তিনি। এসব পালার লিখিত কোন পান্ডুলিপি নেই। শুনে শুনে অথবা দলের সদস্যরা মিলে তৈরি করেছেন।
পুহাতু বর্মণ বলেন, মনের টানেই মূলতঃ গান করি। বাবা গান করতে গিয়েই জায়গা-জমি সব বিক্রি করেছেন। এখন ভিটে বাড়িও নেই। একটি পালা শুরু হলে দুই রাত থেকে সাত রাতও চলে। কখনো কখনো টাকা পয়সা কিছু পাই না। মাড়েয়ারা (পালা গানের আয়োজক) অনেক গরীব হয়। অনুরোধ ফেলতে পারি না। কোথাও কোথাও রাত প্রতি দুই-আড়াইশ’ টাকা পাই। তিনি জানান, ১৯৫০ সালের দুর্বিক্ষের সময় কচু খেয়ে দিন পার করেছেন। ১৯৭১ সালে আবার পাড়ি জমান ভারতে। কিন্তু দেশের মায়া ছাড়তে পারেননি। স্বাধীনতার পরে আবার ফিরে আসেন দেশে। এর পর পালাটিয়া গান করেই সংসার চালাচ্ছেন তিনি। মাঝে মাঝে হিন্দু বিয়েতে পুরোহিতের কাজ করেন।
পুহাতু বর্মণ বর্তমানে সত্যপীর পালায় কোতয়াল আর শিব দোহার চরিত্রে অভিনয় করছেন। তিনি জানান, তার বয়সি অনেকেই মারা গেছেন। অথবা নানা রোগ শোকে বিছানায় পড়ে আছেন। আশি বছর বযসে তিনি মাত্র একবার হাসপাতালে গেছেন। আর কোনদিন ডাক্তারের মুখোমুখি হননি। তিনি বলেন, পালাটিয়া গানই তাঁকে সুস্থ রেখেছে। গান ছেড়ে দিলে তিনি অসুস্থ হয়ে পরবেন।
পুহাতু বর্মণ যে দলে গান করেন সেই দলের ফকির চরিত্রে (সত্যপীর পালার প্রধান চরিত্র) অভিনয় করেন সমে আলী (৫০)। পুহাতু বর্মণ সম্পর্কে তিনি জানান, বুঝ হওয়া থেকে পুহাতু বর্মণকে অভিনয় করতে দেখে আসছি । অনেক কিছু শিখেছি তার কাছে। গানের প্রতি এত শ্রদ্ধা আর কোন মানুষের আছে কিনা আমার জানা নেই। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ১৫ কি ১৬ বছর আগে একদিন গানের বায়না নিয়েছি। সেদিন পুহাতু কাকার তিন বছরের ছেলেটি মারা যায়। ছেলেকে স্মশান ঘাটে রেখে এসে পুহাতু কাকা আমাদের বলেন, আমার ব্যাপারে চিন্তা করো না। লোকজন আশা করেছে। আমি আজ রাতেই গান করবো।
চোখের পানি মুছতে মুছতে এসময় পুহাতু বর্মণ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মনে অনেক কষ্ট। কষ্টগুলোকে ভুলে থাকার জন্য গান করছি। জমিয়ে রাখা অনেক পুরোনো অভিনযের পোশাকগুলো (কস্টিউম) দেখাতে দেখাতে তিনি বলেন, কেউ খোঁজ নিল না। পালাটিয়া গানও বিলুপ্তির দিকে। এখন খুব বেশি আয়োজন হয় না। আ্য় রোজগারও কমে গেছে। জানি না অসুস্থ হয়ে পড়লে কী হবে।
পুহাতু বর্মণের জন্ম ১৯৩৭ সালে সদর উপজেলার সীতাপাড়া গ্রামে। দুই স্ত্রী আর দুই মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে জীবন যাপন করছেন তিনি। তিনি আশা করেন গ্রামীন জনপদের এসব শিল্পীর দিকে নজর দেবে সরকার।