নিউজ ডেস্ক:
আলাদিনের গল্পের অন্যতম আকর্ষণ ম্যাজিক কার্পেট। এমন এক গালিচা, যা উড়তে সক্ষম আর তার সওয়ারকে নিয়ে যেতে সক্ষম যেখানে যেতে তার মন চায়। আলাদিনের গল্পে এই জাদু কার্পেট খুবই গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এটি না থাকলে আলাদিন আর তার প্রেমিকা শাহজাদী দুষ্টু জাদুকরের কবল থেকে বেঁচে ফিরত না। ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’-র গল্পে বারবার উচ্চারিত হয়েছে ফ্লাইং কার্পেটের কথা। ১৮-১৯ শতকে ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে ইউরোপের একটা বড় অংশের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেন, প্রাচ্য দেশ মানেই সাপুড়ে, ভূত-প্রেত আর উড়ন্ত কার্পেট।
সত্যিই ম্যাজিক কার্পেট সম্ভব ছিল কি কখনো? ইতিহাসবিদরা সেই প্রশ্নের উত্তর না দিলেও অন্য এক জায়গায় তাঁরা আলো ফেলেছেন সম্প্রতি। উনিশ শতকের আগে ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’-র কাহিনিগুলির বেশিরভাগটাই ছিল অলিখিত। এগুলি মধ্যে প্রাচ্যের কফিখানায়, বাজারে, সান্ধ্য দরবারগুলিতে ঘুরে বেড়াত। দাস্তানগো বা কাহিনিওয়ালারা তাদের বলে বেড়াতেন জায়গায় জায়গায়। সেই সব কাহিনিকে একত্র করে ‘আরব্য রজনী’-কে গ্রন্থরূপ দান করেন ভূপর্যটক ও প্রাচ্যতত্ত্ববিদ স্যর রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন। সেখানেই আলাদিনের কাহিনিতে উল্লেখ মেলে উড়ন্ত কার্পেটের। কিন্তু ঐতিহাসিক গবেষণা বলেছে, ‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’-এর কাহিনি যে পুরনো পুথিগুলিতে, সেগুলিতে এই গালিচার উল্লেখই নেই। তা হলে এই বিষয়টা কি বার্টন সাহেবের মনগড়া?
এখনও পর্যন্ত ‘আরব্য রজনী’-র যে পুথিগুলি পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে ‘গ্যালার্ড ম্যানুস্ক্রিপ্ট’-কেই সর্বপ্রাচীন বলে ধরা হয়। এতে মোট ২৮২ টি রাতের কাহিনি বিবৃত রয়েছে। এই পাণ্ডুলিপাতে কিন্তু কোথাও উড়ন্ত কার্পেটের কথা উল্লিখিত নেই। বেশ কিছু মহাফেজখানার ধুলো ঘেঁটে ইতিহাসবিদরা এমন এক তথ্য আবিষ্কার করলেন, যাকে চমকপ্রদই বলা যায়। ১৩ শতকের একটি পাণ্ডুলিপিতে তাঁরা জাদু কার্পেটের উল্লেখ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এই পুথির রচয়িতা বেন শেরিরা নামের এক ইহুদি পণ্ডিত। শেরিরা যে কাহিনি লিখে গিয়েছেন, তার নায়ক বাইবেল-এর বিখ্যাত চরিত্র রাজা সলোমন।
শেরিরার কাহিনি এই প্রকার— রানি শেবার দরবারে একজন অ্যালকেমিস্ট ছিলেন, যিনি একটা ছোট গালিচা তৈরি করেছিলেন, যা শূন্যে ভেসে থাকতে সমর্থ। এই গালিচা তৈরির সময়ে এর রংয়ে এমন কিছু মেশানো হয়েছিল, যা মাধ্যাকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারত। এই গালিচাই শেবা তাঁর প্রেমিক রাজা সলোমনকে উপহার দেন। সোনা-রুপো দিয়ে অলঙ্কৃত ছিল এবং তাতে বসানো ছিল দামি পথর। কার্পেট যখন সলোমনের দরবারে এসে পৌঁছয়, তখন তিনি জেরুসালেমের বিখ্যাত মন্দির তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি স্বয়ং ওই উপহার গ্রহণ করতে পারেননি। সেটা গিয়ে পড়ে তাঁর কোনও সভাসদের হাতে। এই খবর পেয়ে শেবা খুই আহত হন এবং আর কোনও ম্যাজিক কার্পেট তৈরি না করার সিদ্ধান্ত নেন। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে সেই অ্যালকেমিস্টও আর তৈরি করেননি জাদু গালিচা। ক্রমে এই বিদ্যা লুপ্ত হয়। পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় উড়ন্ত কার্পেট।
অন্য ভার্সন অনুযায়ী, এই অ্যালকেমিস্টের শিষ্যরা এই বিদ্যা বহন করেন দীর্ঘ কাল এবং মেসোপটেমিয়ায় তাঁরা এই কার্পেট তৈরির কাজ চালিয়ে যান। আবার অন্য এক কাহিনি জানায়, সলোমন এই কার্পেটটি পেয়েছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরের কাছে থেকে। কার্পেটটি ছিল বিশাল, এটি ৪০০০ জন মানুষকে বহন করতে পারত। কিন্তু সলোমনের আত্মগর্ব বাড়তে থাকায় ইশ্বর সেই গালিচার গুণ নষ্ট করে দেন। একদিন উড়ন্ত অবস্থাতেই সেই গালিচার পতন ঘটে। ৪০০০ সওয়ারি এর ফলে মারা যান।
এই সব কাহিনি থেকে এ কথাও জানা যায়, উড়ন্ত কার্পেট কেবল এক পরিবহণ মাধ্যম ছিল না। এটিকে যুদ্ধের সময়ে অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হত। পার্থিয়ার রাজে দ্বিতীয় ফ্রাটেস ১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেলুসিড গ্রিক সাম্রাজ্যের রাজা সপ্তম অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের লোককাহিনিতে এমন কথা চলিত রয়েছে যে, ফ্রাটেস জারগোস পর্বত পেরনোর জন্য একটি উড়ন্ত কার্পেট ব্যবহার করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের প্রশ্ন— তা হলে কি উড়ন্ত গালিচা গল্পকথা নয়? রানি শেবার সভার সেই অ্যালকেমিস্টের শিষ্যদের পরমপরাতেই কি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে তৈরি হতে ফ্লাইং কার্পেট? সত্যিই কোন রাসায়নিকের গুণে অগ্রাহ্য করা যেত মাধ্যাকর্ষণকে? এ নিয়ে ভেবে চলেছেন ইতিহাস ও গণসস্মৃতির মধ্যেকার ধূসর অঞ্চল নিয়ে গবেষণারত ইতিহাসবিদরা।
সূত্র: এবেলা।