ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ গৌতম আদানির মালিকানাধীন আদানি গ্রুপের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের অসম বিদ্যুৎ চুক্তির খেসারত দিচ্ছে দেশের মানুষ। আদানির সঙ্গে দেশের স্বার্থবিরোধী অসম চুক্তি নিয়ে শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে ছিল অসন্তোষ ও ক্ষোভ। হাসিনা সরকারের পতনের পর ইউনিটপ্রতি অতিরিক্ত কয়লা ব্যবহার, বিল পরিশোধে বিলম্বের জন্য উচ্চহারের সুদসহ ক্যাপাসিটি চার্জ ধরে অতিরিক্ত পাওনা দাবি করা হচ্ছে। ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়মিত বিলের জন্য তাগিদ দিয়ে উৎপাদনও কমিয়েছে আদানি।
সাবেক সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ পাওয়ায় আইনের কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে। ভারতকে সন্তুষ্ট করা অসম চুক্তিতে বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনে এখন ফেঁসে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে প্রায় ৪০ কোটি মার্কিন ডলার শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ পিডিবির ঘাড়ে। প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাব করলে তা প্রায় চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
রহনপুর কাস্টমস স্টেশন দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির নিয়ম না থাকলেও তা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অনিয়ম ও ক্ষমতার দাপটে বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো ধরনের বিল অব এন্ট্রি সাবমিট করা হয়নি। অথচ যেকোনো ধরনের আমদানিতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা বাধ্যতামূলক। আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির পুরো প্রক্রিয়াই ছিল অবৈধ ও ক্ষমতার নগ্ন হস্তক্ষেপ।
এই প্রক্রিয়ায় যেকোনো ধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা। অন্যদিকে পিডিবির কর্মকর্তারা দায় চাপিয়েছেন চুক্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের। তবে শুল্ক ফাঁকির চেয়ে অসম চুক্তিটাই মুখ্য বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এর মধ্যে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, কুমিল্লা আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে আসে বিদ্যুৎ। তবে মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য শুল্ক-করসংক্রান্ত ছাড়পত্র জারি হয়েছে। বাকি বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর ছাড়ের কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। এ ছাড়া আদানিসহ বিভিন্ন পথে যে বিদ্যুৎ আসছে, এর জন্য শুল্ক আইন মেনে বিভিন্ন শুল্ক স্টেশনে বিল অব এন্ট্রি জমা দেওয়ার কথা, কিন্তু কখনো বিল অব এন্ট্রি জমার তথ্য নেই কাস্টমসের কাছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন চুক্তি খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে কাস্টমস গোয়েন্দা আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তিতে শুল্কে অনিয়ম খুঁজতে আট কর্মকর্তার সমন্বয়ে কমিটি করে। কমিটির দায়িত্ব ছিল ভারত থেকে আনা বিদ্যুতের দায় শোধ, প্রতি ইউনিটের দাম, প্রযোজ্য শুল্ক-কর ও শুল্ক আইন মেনে আমদানি করার সব তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা খতিয়ে দেখা। তবে অনিয়ম ছাড়া কিছুই খুঁজে পায়নি কমিটি।
প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আদানির কাছ থেকে ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলারের বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে। এই আমদানি করা বিদ্যুতে ৫ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৫ শতাংশ আগাম করসহ মোট করভার ৩১ শতাংশ। সে হিসাবে আদানির কাছ থেকে এনবিআরের পাওনা রাজস্বের পরিমাণ ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলার, যা প্রায় চার হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমান।
পিডিবি জানায়, আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বাস্তবায়ন চুক্তি (আইএ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ২০২২ সালের মার্চে এনবিআরের কাছে শুল্ক-কর মওকুফের আবেদন করে। কিন্তু এনবিআরের শুল্ক অব্যাহতি ও প্রকল্প অব্যাহতি শাখা থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। পরে ২০২৩ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে অব্যাহতি বিষয়ে চুক্তির আগে এনবিআরের কোনো মতামত নেওয়া হয়েছিল কি না, জানতে চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দেয় এনবিআর। তবে সেই চিঠির জবাব দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ কোনো শুল্ক-কর মওকুফ করা হয়নি।
বিদ্যুৎ আমদানির বিপরীতে কোনো শুল্ক ছাড় প্রসঙ্গে এনবিআর জানায়, আদানির বিদ্যুতে শুল্ক ছাড় পেতে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে পিডিবি জানায়, আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে সরকারের আইএ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ১২তম অধ্যায়ে যাবতীয় শুল্ক-কর মওকুফের উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে এনবিআরের কোনো অনুমোদন না নেওয়ায় শুল্ক-কর প্রযোজ্য।
প্রতিবেদন বলছে, সীমান্ত দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি পিডিবির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। এ ছাড়া রহনপুর কাস্টমস স্টেশনের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ আমদানির কোনো বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়নি। রহনপুর শুল্ক স্টেশনের আমদানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় বিদ্যুৎ নেই। এনবিআর শুল্ক-কর অব্যাহতির প্রজ্ঞাপন জারি করেনি।
বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে যেকোনো ধরনের পণ্য আমদানি করলে তার এইচএস কোড অনুযায়ী তথ্য সংরক্ষিত থাকে কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে। তবে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির এইচএস কোডের বিপরীতে কোনো তথ্য পায়নি কমিটি।
কমিটির মতামত : আদানির বিদ্যুৎ আমদানির রুট কাস্টমস আইন অনুযায়ী অনুমোদিত নয়। সেহেতু কাস্টমস আইনের ক্ষমতাবলে কাস্টমস স্টেশন ঘোষণা করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ আমদানিতে বিল অব এন্ট্রি কোন পদ্ধতিতে দাখিল করা হবে, সে বিষয়ে এনবিআর নির্দেশনা দিতে পারে। শুল্ক-কর পরিশোধ না করেই আমদানি করায় পিডিবিকে শুল্ক-কর পরিশোধের নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া কাস্টমস আইনের ৯০ ও ৯১ ধারা অনুযায়ী পিডিবির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, বিল অব এন্ট্রি সাবমিট না করে কোনো পণ্য আমদানি করলে তা আমদানি হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এটা অবৈধ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে। এটা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চোরাচালান। এ ছাড়া আমদানিকারক হিসেবে শুল্ক ফাঁকির টাকা পরিশোধে পিডিবির বাধ্যবাধকতা আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সংস্থাটির সদস্য (অর্থ) অঞ্জনা খান মজলিশকে ফোন করা হলে তিনি সংস্থার প্রধান অথবা জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
এরপর পিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শামীম হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ৪০ কোটি মার্কিন ডলার শুল্ক-কর ফাঁকির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এনবিআরের এই প্রতিবেদনটি বোধ হয় ঠিক নয়। আদানি আমাদের কাছে জুন পর্যন্ত ৮০ কোটি ডলার দাবি করেছে। অক্টোবরের শুরু পর্যন্ত সেটা প্রায় ৮৫ হাজার কোটি ডলার পেরিয়ে যাবে। আমরা আদানিকে বলেছি, আমরা তাদের পাওনার সঙ্গে একমত নই। কিছু বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের ভিন্নমত রয়েছে। আদানি তাদের মনগড়া রিপোর্ট করে ও বিল ধরে আমাদের বিল সাবমিট করেছে। আমরা জানিয়েছি, ৩০ জুন পর্যন্ত তারা আমাদের কাছে সর্বোচ্চ পেতে পারে ৫৪.৮৪ কোটি ডলার। এর বিপরীতে তাদের দাবি ৮০ কোটি ডলার। অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ কোটি ডলার। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা করে এটা ঠিক করতে হবে।’
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, আদানির সঙ্গে চুক্তিটাই ছিল অসম। এই চুক্তির খসড়াও তারাই করেছে, সুবিধাও তারাই পেয়েছে। খসড়া পরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কি না, সেটাও অজানা। এই চুক্তির বেশ কিছু শর্তের কারণে ২৫ বছরে বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রায় তিন লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি নেবে কোম্পানিটি।