নিউজ ডেস্ক: আমরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছি। তার স্বীকৃতিও আমরা পেয়েছি। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে এখন পালিত হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজও আমাদের ভাষা সৈনিক বা ভাষা সংগ্রামীদের নামের কোনো তালিকা সরকারিভাবে প্রস্তুত হয়নি। বাংলা ভাষার জন্য বুুকের রক্ত দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন সালাম, রফিক, জব্বারের মতো অকুতোভয় প্রাণ। কিন্তু ভাষার এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন আরও অনেকে। তাদের কারও কারও নাম আর অবদানের কথা আছে শুধু নানা লেখনীতে।
ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামীদের তালিকা তৈরির আবেদন জানিয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তালিকা তৈরির নির্দেশ দিলে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে একটি তালিকা পেশ করেছিল,যাতে জিল্লুর রহমান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবদুল মতিন, হাবিবুর রহমানসহ ৬৮ জন ভাষা সংগ্রামীর নাম ছিল। তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, কিন্তু সেখানে এমন কিছু নামও ছিল যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ নয় এবং সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে- এমন অভিযোগে এ তালিকা প্রণয়নের কাজটি স্থগিত করা হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ঢাকাসহ দেশের সব জেলায় কমিটি গঠন করে তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভাষা সৈনিক আহমদ রফিককে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল শুধু ঢাকায়। কমিটিতে আরও ছিলেন রফিকুল ইসলাম ও মুনতাসীর মামুন। কিন্তু সেই কমিটির মাত্র একটি বৈঠক হয়েছিল, যাতে কাজের পদ্ধতির জটিলতা নিয়েই শুধু আলোচনা হয়। এরপর থেকে তালিকা প্রণয়নের কাজটি কার্যত বন্ধ রয়েছে এবং বিষয়টি সরকারিভাবে সম্পন্ন করার আদৌ আর কোনো উদ্যোগ নেই বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
ভাষা সংগ্রামীদের নামের তালিকার ব্যাপারে সরকারের কোনো পরিকল্পনা এখন আছে কিনা জানতে চাইলে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর যুগান্তরকে বলেন, ‘ভাষা সৈনিকদের নামের তালিকা তৈরি করার জন্য হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে ভাষা সৈনিকদের কোনো সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়নি। কাদেরকে আমরা ভাষা সৈনিক বলব? যারা সে সময় জেল খেটেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন? কাদেরকে? আর ভাষা আন্দোলন কিন্তু সারা দেশেই হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছেন, নামের তালিকা হয়েছে। যে কারণে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা করা তুলনামূলক সহজ ছিল। কিন্তু ভাষা সংগ্রাম যখন হয়েছে তখন তো সে ধরনের কোনো তালিকার ব্যাপার ছিল না।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা এখন যাদের ভাষা সৈনিক হিসেবে জানি তাদেরকে কিন্তু সরকারিভাবে নয়, দেশের মানুষই ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশের নানা জায়গায় ভাষা সৈনিক যারা তারা এভাবেই স্বীকৃত। আমার মতে বিষয়টি এভাবে থাকাটাই ভালো। কারণ তালিকা তৈরি করতে গেলেই নানা তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হবে। তবুও আমরা চেষ্টা করছি ভাষা সৈনিকদের একটি সংজ্ঞা তৈরি করতে।’
ভাষা সংগ্রামীদের নামের তালিকা প্রস্তুত করার বিষয়টি জটিল হিসেবে উল্লেখ করে ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক গত বছর যুগান্তরকে বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে চেষ্টা করা হলেও বিষয়টি নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। নানান জায়গা থেকে ভাষা সংগ্রামীর দাবি করে নানানজন।’
এ ব্যাপারে সম্প্রতি আহমদ রফিক যুগান্তরকে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণে অবহেলা হয়েছে। সেটা সব আমলেই। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ১৬ খণ্ডে প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র সংরক্ষণ, সংকলন বা ইতিহাস ধরে রাখার জন্য কিছুই হয়নি। এমনকি বর্তমানে ইচ্ছে থাকলেও আর সেটা করা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের বন্ধু-বান্ধব যারা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই আজ প্রয়াত। আমার মতো দু’চারজন বেঁচে আছেন।’ ভাষা সৈনিক অধ্যাপক ফুলে হুসেন বলেছেন, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশের উৎপত্তি। আমাদের জাতীয়তা বোধের সব কিছুই আমরা শিখেছি ভাষা আন্দোলন থেকে। আমরা বাঙালি, বাংলা ভাষায় কথা বলি, আমাদের দেশ বাংলাদেশ- এসব বোধ এ আন্দোলন থেকেই পাওয়া। ভাষা আন্দোলন থেকেই উৎসারিত হয়েছে সব মন্ত্র। অথচ এত বড় একটি আন্দোলনের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের নামের কোনো তালিকা নাই এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই, আর দেরি না করে অচিরেই তালিকাটি করার জন্য। অন্তত যে কজন ভাষা সংগ্রামী বেঁচে আছেন তারা দেখে যেতে পারবেন।’