চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য
উপঢৌকন ও স্যাম্পল সুবিধা নিয়ে ব্যবস্থাপত্রে নিম্ন মানের ওষুধ
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি:চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের চাপে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। প্রায় প্রতিদিন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের কক্ষ এবং কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। রোগীরদের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন চেয়ে নিয়ে ছবি তোলারও অভিযোগ উঠেছে। সপ্তাহে দুই দিন বৃহস্পতি ও রোববার বেলা একটা থেকে দুইটা পর্যন্ত ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ডাক্তার ভিজিট করার নিয়ম, তবে এ নিয়ম মানছেন না তাঁরা এবং রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তাও মানা হচ্ছে না।
অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে স্যাম্পল উপঢৌকন ও বিভিন্ন প্রকার উপহার সামগ্রী নিয়ে তাঁদের যেকোনো সময় প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির উপঢৌকন ও স্যাম্পল সুবিধার কারণে চিকিৎসকেরা ওষুধের মান ও গুণ বিবেচনায় না রেখে ব্যবস্থাপত্রে নি¤œ মানের কোম্পানির ওষুধের নামও লিখে থাকেন। কোন কোম্পানি কত বেশি সুবিধা দিয়ে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন করতে পারেন, তা নিয়ে প্রতিনিধিদের মধ্যে চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। কোনো রোগী চিকিৎসকের রুম থেকে বের হলে প্রতিনিধিরা ব্যবস্থাপত্র যাচাই করে দেখেন, চিকিৎসকেরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ওষুধের নাম লিখছেন কি না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হওয়ার পরপরই রোগীদের প্রেসক্রিপশন চেয়ে নিয়ে ছবি তুলে রাখেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এতে বিভ্রান্তিতে পড়ছেন সাধারণ রোগীরা। কোনো কোনো ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি নিজের কোম্পানির ওষুধের জন্য সুপারিশও করে থাকেন। কখনো কখনো প্যান্ট, শার্ট ও সুজ পরে থাকা এসব ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের বড় ডাক্তার ভেবেও ভুল করে বসেন রোগীরা।
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে স্পষ্ট লেখা ছিল ‘রোগীদের হয়রানি ও গোপন বিষয় প্রকাশ বন্ধের লক্ষ্যে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলা বন্ধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়।’
গত কয়েক দিনে হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারদের চেম্বারগুলো ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে ডাক্তারদের ভিজিট করার যে নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন, তা যেন কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ। তাঁদের কর্মকা- দেখে মনে হয়, যেন জনস্বার্থে নিয়ম প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু কোম্পানিগুলোর ওষুধ বিক্রি করার।
কেবল মাত্র দিনে বহির্বিভাগে নয়, রাতে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোর ভেতরেও হাসপাতালের নার্সদেরকক্ষে প্রবেশ করে ভর্তি রোগীদের প্রেসক্রিপশন ফাইল ঘেটে দেখেন, চিকিৎসকেরা তাঁর কোম্পানির ওষুধ লিখেছে কি না। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ভর্তি রোগীদের দিনে দুবার সকালে এবং রাতে পরিদর্শন ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন। চিকিৎসকেরা চিকিৎসা ও প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলে রাত ১১টার পর প্রতিনিয়তই ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে দেখা যায় বিভন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের। রোগীদের গুছিয়ে রাখা প্রেসক্রিপশন ফাইল কোনো অনুমোতি ছাড়াই ঘাটাঘাটি করেন তাঁরা এবং ছবিও তুলে রাখেন। প্রতিনিধিদের এসব কর্মকা-ে নার্সরা বিরক্তবোধ করলেও চিকিৎসকদের সঙ্গে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সুসম্পর্ক থাকায় কিছুই বলতে পারেন না তাঁরা।
এভাবেই সদর হাসপাতালে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চলছে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক-সংকটের কারণে রোগীরা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। কোনো রকম চিকিৎসা পেয়ে যখন হাঁফছাড়ার সময়, তখন এসব ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের অনাকাক্সিক্ষত কর্মকা- দেখে মনে হয় যেন এ দেশে আইন বা নিয়ম বলে কিছুই নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. শামীম কবির বলেন, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা নির্ধারিত সময় ছাড়া চিকিৎসকদের চেম্বারে প্রবেশ করতে পারবে না, জরুরি বিভাগেও না। এ বিষয়ে তাঁদের নিষেধ করা হয়। নির্ধারিত সময় না মেনে চিকিৎসকদের চেম্বারে প্রবেশ ও হাসপাতালে রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার বিষয়ে খুব শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এ এস এম মারুফ হাসান বলেন, ‘হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের চিকিৎসকদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সপ্তাহে দুই দিন বৃহস্পতি ও রোববার বেলা একটা থেকে দুইটা পর্যন্ত সময় নির্ধারিত আছে। এর বাইরেও তাঁরা হাসপাতালে আসেন, কিন্তু ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন কি না, আমার জানা ছিল না। তবে কিছু দিন পূর্বেই এ বিষয়ে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. শামীম কবিরকে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ডেকে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে বলার জন্য জানানো হয়েছে, তাঁরা যেন নির্ধারিত সময় ব্যতীত কর্মসূত্রে হাসপাতালে না আসেন এবং নির্ধারিত সময়ে এলেও রোগীদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে ছবি না তোলেন।’