লিমন শরিফের বয়স যখন তিন বছর, তখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রথমে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কিছুদিন পর কথা বলাও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। স্বাভাবিক চলাচলেও দেখা দেয় সমস্যা।
শিশু লিমনের এমন অস্বাভাবিক অবস্থা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় তার মা–বাবাকে। পরে বাধ্য হয়ে ছেলের পায়ে লোহার শিকল ও তালা দিয়ে বেঁধে রাখতে শুরু করেন তাঁরা। এভাবে কেটে গেছে ১২ বছর। এখন লিমনের বয়স ১৫ বছর। বন্দিজীবনের বাইরের মুক্ত পৃথিবী আজও দেখা হয়নি এই কিশোরের।
লিমন শরিফ ফরিদপুরের সালথা উপজেলার যদুনন্দী ইউনিয়নের উজিরপুর গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর হাফেজ শরিফের ছেলে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট সে।
হাফেজ শরিফের মেয়ে রানীর (২৭) বিয়ে হয়ে গেছে সাত বছর আগে। বড় ছেলে রাজীব (২৪) ও মেঝ ছেলে সজীব (২২) অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেন। দুই ছেলে ও বাবার আয়ে কোনোমতে চলে সংসার।
হাফেজ শরিফ বলেন, তখন বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে চিকিৎসা করান। কিছুদিন পর লিমন মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, বন্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক কথাবার্তাও। তখন থেকে শুধু ‘মা’, ‘বাবা’ বলতে পারে। ওকে সুস্থ করতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। তবে সুস্থ করে তুলতে পারেননি।
কোনো সহায়-সম্পত্তি নেই হাফেজ শরিফের। তিন শতাংশ জমির ওপর নির্মিত বসত ঘর—এর মালিকও কাগজ–কলমে তিনি নন। একজনের কাছ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে জমিটি কিনেছিলেন। কিন্তু দলিল এখনো হাফেজ শরিফের নামে করা হয়নি।
এর মধ্যেও শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে লিমনকে একাধিকবার স্থানীয় হাসপাতালে ও কবিরাজি চিকিৎসা করিয়েছেন। তবে টাকার অভাবে ভালো কোনো চিকিৎসককে দেখাতে পারেননি।
১২ বছর ধরে শিকলে বাঁধা লিমনের দিনরাত চলে একই চক্রে। দিনেরবেলা খোলা রান্নাঘর এবং রাতে টিনের চাল ও পাটখড়ির বেড়ার ঘরের মেঝেতে রাখা হয় তাকে। শিকলের এক মাথা থাকে লিমনের পায়ে এবং অন্য মাথা থাকে রান্নাঘরের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা।
আক্ষেপ করে হাফেজ শরিফ বলেন, ‘আমি দিন কামাই করি, দিন খাই। আমার তো ওরে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নাই। প্রতিবন্ধী ভাতার একটা কার্ড ছাড়া ওর কিছু নাই।’
লিমনকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার কারণ জানতে চাইলে দরিদ্র এই বাবা বলেন, ‘কেউ কি চায় নিজের ছেলেরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে? ছাড়া পাইলে বাড়ি থেকে বাইর হইয়া যায়। গাছে ওঠে, পুকুরে নামে, আশপাশের লোকদের গাছগাছালি নষ্ট করে। নিজে থেকে বাড়িতে আসে না। কয়েক গ্রাম ঘুইরা ধইরা আনতে হয়। তাই বাইন্ধা রাখি। এর মধ্যে গত ১২ বছরে ৯ বার শিকল ছিইড়া পালাইছে।’
লিমনের মা সুফিয়া বেগম বলেন, ‘ও সুস্থ হবে কি না, জানি না। অনেক টাকা খরচ করছি। এখন আর সামর্থ্য নাই। ওর এই অবস্থা সহ্য করতে পারি না।’
লিমনের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন যদুনন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘লিমনকে কোনো চিকিৎসায় সুস্থ করা গেলে সামর্থ্য অনুযায়ী আমি সহযোগিতা করব।’