জ্ঞানই ছিল ভারতবর্ষের সুফি সাধক ও আধ্যাত্মিক রাহ্বারদের সবচেয়ে ধ্যান-জ্ঞান ও কামনা-বাসনা। তাঁর জ্ঞানের প্রসারে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং জ্ঞানের সেবা করেছেন। তাদের অনেকেই ছিলেন সাহিত্যের বোধ ও উচ্চতর জ্ঞানগত দক্ষতার অধিকারী। তারা বিশ্বাস করতেন, ইলম তথা জ্ঞান ছাড়া আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় লাভ করা সম্ভব নয়। মূর্খ সুফিরা শয়তানের ক্রীড়ানক।
এজন্য দেখা গেছে, বহু প্রতিভাবান ও যোগ্য ব্যক্তিদের তারা লেখাপড়া সম্পন্ন করার আগে দ্বিন প্রচারের অনুমতি তথা খেলাফত দান করেননি। প্রকৃতপক্ষে অতীতের শিক্ষা আন্দোলন ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণকে পীর-মাশায়েখরা উৎসাহিত করেছেন, নানাভাবে অবদান রেখেছেন। হয়ত তারা প্রত্যক্ষভাবে করেছেন বা পরোক্ষভাবে করেছেন। কাজি আবদুল মুক্তাদির কিন্ধি ও শায়খ আহমদ থানেশ্বরি (রহ.) ছিলেন শায়খ নাসিরুদ্দিন ‘চেরাগে দেহলভি’ (রহ.)-এর শিষ্য এবং একাদশ শতকের প্রখ্যাত শিক্ষক। তারা ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার শীর্ষ পর্যায়ে নেতৃত্ব দান করেছেন। শায়খ লুৎফুল্লাহ কুয়েরভি (রহ.) ছিলেন চিশতিয়া তরিকার বিশিষ্ট বুজুর্গ। তাঁর শিক্ষা কার্যক্রমের ধারা ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বেশির ভাগ সময় আমরা মাদরাসা ও খানকাকে অঙ্গাঙ্গিভাবে চলতে দেখেছি। জৌনপুরের খানকায়ে রশিদিয়া ও লাখনৌর শায়খ পীর মুহাম্মদের মাদরাসা এবং দেহলভির শায়খ ওয়ালিউল্লাহ বিন আবদুর রহিম (রহ.)-এর মাদরাসা ও গাঙ্গুহের শায়খ রশিদ আহমদ (রহ.)-এর খানকা জ্ঞানের শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার দীক্ষার সমন্বয়ের উত্তম দৃষ্টান্ত।
এসব মাশায়েখ ও তাদের খানকার শিক্ষাদান পদ্ধতির অনন্য দিক হলো, তারা মনুষ্যত্ব, মানবিকতা ও আল্লাহ প্রেমের সহযোগে ধর্মীয় জ্ঞানের প্রসার ঘটান। একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিদ্যালয় ছিল তাদের খানকাগুলো। যেখানে হাজারো মানুষের আশ্রয় মিলত। তবে তাদের শিক্ষা ছিল প্রাতিষ্ঠানিকতার ভার ও কাঠামো মুক্ত। ফলে সহজেই যে কেউ অংশ গ্রহণ করত পারত। আবার স্বল্প ও দীর্ঘ সময়ের জন্য অংশগ্রহণের সুযোগ থাকত। তারা সেখানে খাদ্য-পানীয় ও জীবনোপকরণ পেত। তাদের দস্তরকাখানে সৃষ্টি হতো অনন্য দৃষ্টান্ত। তাদের উদার দস্তরখানে একত্র হতো শত্রু ও মিত্র, আত্মীয় ও অনাত্মীয়, ধনী ও দরিদ্র্য। শায়খ নিজামুদ্দিনের দস্তরখান সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। উদারতা, বাহারি খাবার, স্বাদ ও সুন্দর পরিবেশনার ক্ষেত্রে তা উপমায় পরিণত হয়েছিল।
খানকা ও বিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় তারা শাসকদের সহযোগিতার প্রত্যাখ্যান করতেন এবং জনগণকে তাতে সম্পৃক্ত করতেন। যেন শাসকের প্রভাব থেকে আত্মরক্ষা করা যায় এবং জনসাধারণের দ্বিনি চেতনা ও দায়িত্ববোধ তৈরি হয়। শায়খ সাইয়েদ মুহাম্মদ সাঈদ আম্বালাভি (রহ.) ছিলেন খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের মনীষী।
তাঁর জীবনী রচয়িতারা লেখেন, ‘তাঁর খানকায় প্রথম যুগেই যারা ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত থাকত তাদের সংখ্যা পাঁচ শর চেয়ে কম ছিল না এবং সমপরিমাণ লোক সব সময় যাওয়া আসার মধ্যে থাকত। একবার তাঁর সঙ্গে সম্রাট ফররুখ শিয়ারের আমির রওশন দৌলা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে খানকা নির্মাণের জন্য ৬০ হাজার রুপি উপহার দেন। শায়খ রওশন দৌলাকে বলেন, অর্থগুলো এক জায়গায় রেখে তিনি যেন বিশ্রামে যান। ফলে রওশন দৌলা ফিরে যান এবং শায়খ অসহায় মানুষদের খবর দেন। তিনি আম্বালাহ, থানেশ্বর, সেরহিন্দ ও পানিপথের এতিম, অসহায় ও দরিদ্র মানুষের ভেতর সমুদয় অর্থ বিতরণ করে দেন। তাঁর হাতে একটি অর্থও রাখলেন না। এরপর রওশন দৌলা এলে শায়খ তাকে বলেন, ‘অসহায় মানুষ ও যারা নিজেদেরকে আল্লাহর রাস্তায় নিয়োজিত রেখেছে তাদের সেবা করার সওয়াব ভবন নির্মাণের চেয়ে বেশি।’ একবার শায়খ সাইয়েদ মুহাম্মদ সাঈদ (রহ.)-এর কাছে সম্রাট মুহাম্মদ ফররুখ শিয়ার, আমির রওশন আলী ও আমির আবদুল্লাহ খানের চিঠি পৌঁছায় তিন লাখ রুপিসহ। তিনি পুরো টাকা প্রতিবেশী গ্রাম ও এলাকাগুলোর অধিবাসীদের মধ্যে বিতরণ করে দেন।
সুফি সাধকদের খানকা ও বিদ্যালয়গুলো ছিল বৈষম্যহীন এবং সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য উন্মুক্ত।