নিউজ ডেস্ক:
থাইল্যান্ডের গুহায় আটকা পড়া দলটির বাকি পাঁচ জনকে বাইরে বের করে আনতে চরম ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ধার অভিযান চালিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ডুবুরিরা।
ভেতরে থাকা চার কিশোর ও তাদের ফুটবল কোচ ভেতরে সুস্থ আছেন বলে জানা গেছে। তারা বন্যায় ভেসে যাওয়া গুহাটির সংকীর্ণ পথ দিয়ে ডুবুরির সঙ্গে বের হয়ে আসতে প্রস্তুত বলেও জানা যায়।
গত দুই দিন ধরে অভিযান চালিয়ে আটজনকে গুহা থেকে বের করে আনা হয়।
থাম লুয়াং গুহা ভিতরের এই অভিযান বিশ্বব্যাপী সবার মনোযোগ কেড়েছে।
ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বন্যার কারণে গত ২৩ জুন এই দলটি গুহার ভেতর আটকা পড়ে। পরে গত সপ্তাহে তাদের সন্ধান পায় ডুবুরিরা।
গুহা থেকে এরইমধ্যে যে আট কিশোরকে উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের কাউকেই জনসমক্ষে আনা হয়নি।
তবে এটা বলা হয়েছে যে তারা প্রত্যেকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছে।
সোমবার সন্ধ্যায় চারজনকে গুহা থেকে বের করে আনার পর তাদের স্ট্রেচারে করে পাশের চিয়াং রায়ে শহরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে রোববার উদ্ধার করা হয় আরো চার কিশোরকে।
তাদের সবাইকে আরো অন্তত সাত দিন হাসপাতালে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
তাদেরকে এখনও বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি।
সেখানে তাদের এক্স-রে করার পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষা করা হয়।
এরমধ্যে দুইজনকে ফুসফুস প্রদাহজনিত চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
থাই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উদ্ধারকারী কিশোররা জাউ ভাত খেতে পারছে।
তারা মাংস খেতে চাইলেও হজমে সমস্যা হতে পারে এমন আশঙ্কায় তাদের সেটা দেয়া হচ্ছে না। কেননা তারা প্রত্যেকেই গত ১০ দিন ধরে না খেয়ে ছিল।
থাই নৌবাহিনীর এক সদস্য তার ফেসবুকে জানান, “পুরো কাজ চলছে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। অ্যাম্বুলেন্সগুলো যখন গুহার প্রবেশদ্বার থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছিল। তখন গাড়ির হেডলাইটের ঝলকানিতে দেখতে পেলাম আরেকটি ছেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এভাবে প্রত্যেকের মধ্যে আশা জেগেছে।”
এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানটি খুবই সূক্ষ্মতা ও সাবধানতার সঙ্গে পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু এই উদ্ধার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন একদিকে যেমন ছিল সাহসী, বিপজ্জনক তেমনি ভীষণ জটিল।
তবে সব সংকটের মধ্যেও প্রতিটি পর্যায়ে সাফল্য এসেছে। এই মানসিক স্বস্তি ধীরে ধীরে সবাইকে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে থাকা উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণ দিয়েছে।
এখানে আরেকটি রাত বিরতি নেয়া হচ্ছে। কেউই তাড়াহুড়া করতে চায়না। চারিদিক থেকে ডুবুরি দলের নিষ্ঠা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রশংসা আসছে। তারা এই চ্যালেঞ্জ নিতে উঠেপড়ে লেগেছে। তবে এখনও ওই ফুটবল কোচসহ কয়েকজন আটকা পড়ে আছে।
১৭ দিন ধরে তারা ভূগর্ভের ওই অন্ধকার জায়গাটিতে আটকে আছে। মঙ্গলবার আমাদের আবারও দম বন্ধ করে থাকতে হবে। এই আশায় যে ততোক্ষণ পর্যন্ত ভেতরের মানুষগুলোকে আমরা অক্ষত অবস্থায় পাব।
৯০ জন দক্ষ ডুবুরির একটি দল, যাদের ৪০জন থাইল্যান্ডের এবং বাকিরা বিভিন্ন দেশের- তারা ওই গুহায় উদ্ধার অভিযান চালিয়েছে। তারা থাম লুয়াং গুহার ডুবে যাওয়া অন্ধকার সংকীর্ণ পথ দিয়ে কিশোরদের দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রবেশমুখে নিয়ে নিয়ে এসেছে।
অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই কিশোরদের একটি ক্লান্তিকর যাত্রাপথ পাড়ি দিতে হয়। যেটা কিনা অভিজ্ঞ ডুবুরিদের জন্যও ভীষণ ক্লান্তিকর ছিল।
এই অভিযান প্রক্রিয়া জুড়ে ছিল হাঁটা, পানির ওপর দিয়ে চলা, বেয়ে ওঠা, এবং পানিতে ডুব দিয়ে দড়ি ধরে এগিয়ে যাওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।
সব ডুবুরি বাড়তি সতর্কতার জন্য মুখ জুড়ে মাস্ক ব্যবহার করেন। প্রতিটি কিশোরকে দুইজন করে ডুবুরি সাহায্য করেছে। তারা ওই কিশোরের অক্সিজেন সরবরাহের ট্যাঙ্কও বহন করে।
তবে গুহার সবচেয়ে জটিল অংশটি হল অর্ধেক পথের “টি-জংশন”। যেটা এতোটাই সংকীর্ণ যে তার ভেতর দিয়ে যাওয়ার জন্য ডুবুরিদের অক্সিজেন ট্যাঙ্কটি খুলে ফেলতে হয়েছে।
ওই সুড়ঙ্গের বাইরে রয়েছে আরেকটি স্থান যার নাম দেয়া হয়েছে চেম্বার থ্রি। যেটা ডুবুরিদের জন্য ফরোয়ার্ড বেইজে পরিণত হয়।
সেখানে কিশোররা বাকি পথ পাড়ির দেয়ার আগে কিছু সময় জিরিয়ে নিতে পারে। পরে তারা পায়ে হেটে সহজেই প্রবেশমুখে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে তাদের চিয়াং রায়ের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া এক প্রাক্তন থাই নৌবাহিনীর ডুবুরির মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে দিয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে এই যাত্রা কতোটা বিপজ্জনক ছিল।
সামান গুনান নামে ওই ব্যক্তি শুক্রবার গুহার মধ্যে দিয়ে কিশোরদের অক্সিজেন ট্যাঙ্ক দিয়ে ফিরছিলেন। এ সময় পানির ভেতরেই অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যান তিনি।
তিনি প্রথমে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, পরে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তার সহকর্মীরা জানান, “তাদের বন্ধুর এই আত্মত্যাগ তারা বৃথা যেতে দেবে না।”
উদ্ধার অভিযানের প্রধান বলেন, অভিযানের দ্বিতীয় দিনটি প্রথম দিনের তুলনায় আরো মসৃণভাবে পরিচালিত হয়েছে। প্রতিবার ডুবুরিদের দুঘণ্টারও কম সময় লেগেছে।
একটি বিশাল পাম্পিং মেশিন দিয়ে গুহার ভেতরের পানির স্তর নীচে নামিয়ে আনা হয়। যা পুরো যাত্রাকে আরো সহজ করে তোলে।
এক সপ্তাহ আগে এক ব্রিটিশ উদ্ধারকারী ডুবুরি গুহার প্রবেশমুখ থেকে চার কিলোমিটার ভেতরে ওই স্থানটিতে দলটির সন্ধান পায়।
১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী ওই কিশোররা স্থানীয় ফুটবল দল ওয়াইল্ড বোয়ারসের সদস্য বলে জানা গেছে।
দলটি তাদের কোচের সঙ্গে ভ্রমণে বের হতে গিয়ে এই গুহায় প্রবেশ করে এবং ভেতরে আটকা পড়ে।
নিখোঁজের নয় দিন পর তাদেরকে গুহার গভীর অন্ধকারে পাওয়া যায়।
ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল পরিচালনাকারী সংস্থা ফিফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই কিশোরদের রোববার অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মস্কোর ফাইনাল খেলা মাঠে বসিয়ে দেখানো হবে।
তবে তারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করার মতো ভাল অবস্থায় থাকবে কিনা, সেটা বিবেচনা করা হবে।
ওই ফুটবল দলের সদস্য এবং তাদের কোচের কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
ক্যাপ্টেন ডুগানপেট প্রমটেপ- বয়স ১৩ বছর, তিনি দলের অত্যন্ত সম্মানিত সদস্য যিনি দলকে উজ্জীবিত রাখতে কাজ করেন। তিনি থাইল্যান্ডের বেশ কয়েকটি পেশাদার ক্লাব থেকে স্কাউটিংয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
আদুল স্যাম-অন- ১৪ বছর বয়স, মিয়ানমার বংশোদ্ভূত, কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারেন এবং দলের একমাত্র সদস্য যিনি ব্রিটিশ ডুরিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। যারা সর্বপ্রথম তাদের সন্ধান পায়।
পিরাপাত সোমপিয়াংজাই- বয়স ১৭ বছর, যেদিন তারা গুহায় আটকে পড়ে অর্থাৎ ২৩ জুন তার জন্মদিন ছিল। তার জন্মদিন উদযাপনের জন্য সবাই যে খাবারগুলো এনেছিল, সেগুলোই তাদের এতদিন টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।
একাপোল চান্টাওং- বয়স ২৫ বছর, দলের সহযোগী কোচ, উদ্ধারকারীদের মতে তিনি সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় আছেন। কারণ তিনি বার বার খাবার খেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং তার পরিবর্তে সেগুলো ওই কিশোরদের খেতে বলেছেন।