নিউজ ডেস্ক:
হজরত লুত (আ.) জর্দানের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা সাদুম ও আমুরাবাসীর প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। তারা ছিল জগতের অবাধ্য ও পাপিষ্ঠ জাতিগুলোর অন্যতম। পৃথিবীর অন্যান্য নাফরমান জাতির মন্দ কাজগুলো ছাড়াও তারা একটি অশ্লীল ও ঘৃণিত কুকর্ম আবিষ্কার করেছিল। তা হলো, নারীদের পরিবর্তে শ্মশ্রুবিহীন বালকদের সঙ্গে যৌনক্রিয়া চরিতার্থ করা। আধুনিক পরিভাষায় যাকে সমকামিতা বলে। কওমে লুত এতটাই নির্লজ্জ ও হীন চরিত্রের ছিল যে, প্রকৃতিবিরুদ্ধ এ নোংরা কাজকে তারা দোষের মনে করত না। বরং এর জন্য তারা গর্ববোধ করত। আল্লাহর পয়গম্বর লুত (আ.) তাদের এই অশ্লীল ও নোংরা কাজের জন্য তিরস্কার করেন এবং পবিত্র জীবন অবলম্বনের আহ্বান জানান।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি লুতকে পাঠিয়েছিলাম। যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কী এমন কুকর্ম করছ, যা তোমাদের আগে পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি করেনি। তোমরা কামিচ্ছা পূরণের জন্য নারীদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন করো। বরং তোমরা এমন সম্প্রদায়, যারা (সভ্যতা ও মানবতার) সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছ।’ তার সম্প্রদায়ের উত্তর ছিল শুধু এটাই যে, ‘এদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা এমন লোক, যারা পবিত্র থাকতে চায়। এরপর আমি লুত ও তার পরিবারকে সেই জনপদ থেকে উদ্ধার করলাম, তবে তার স্ত্রী ছাড়া। তার স্ত্রী ছিল পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর আমি তাদের ওপর ভীষণভাবে (প্রস্তর) বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। লক্ষ করে দেখ, সেই পাপীদের পরিণতি কেমন হয়েছিল!’ (সূরা আরাফ : ৮০-৮৪)।
আল্লাহ তায়ালা সাদুমবাসীকে ধ্বংস করার জন্য তিনজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন অত্যন্ত সুশ্রী শ্মশ্রুবিহীন পুরুষের রূপ দিয়ে। তারা লুত (আ.) এর গৃহে আশ্রয় নিলে তা জানতে পেরে সেই অসভ্য বর্বর জাতি আগন্তুক মেহমানদের সঙ্গেও এ হীনকর্ম চরিতার্থ করতে উদ্যত হয়। হজরত লুত (আ.) তাদের কাতরভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেন। তিনি বললেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; আমার মেহমানদের ব্যাপারে আমাকে লজ্জিত করো না। আহা! তোমাদের মধ্যে কি সুস্থ প্রকৃতির একজন সৎ লোকও নেই যে, মানবতার পরিচয় দেবে?’ তিনি অস্থির চিত্তে বলে উঠলেন, ‘হায়! যদি তোমাদের সঙ্গে মোকাবিলা করার মতো আমার শক্তি থাকত কিংবা যদি আমি কোনো শক্তিশালী হাতের সহযোগিতা লাভ করতে পারতাম!’ (সূরা হুদ)।
পয়গম্বরের পেরেশানি দেখে আগন্তুক ফেরেশতাত্রয় নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনি ঘাবড়াবেন না। আমরা আজাবের ফেরেশতা। নির্ধারিত সময়েই তাদের ওপর আজাব শুরু হবে। রাতের প্রথম ভাগেই ফেরেশতাদের ইঙ্গিতে লুত (আ.) সপরিবারে এলাকা ছেড়ে চলে গেলেন। তবে তার অবাধ্য স্ত্রী রয়ে গেল। সে ছিল অবিশ্বাসী ও সমকামীদের সহযোগী। রাতের শেষ প্রহরে একটি ভয়ংকর গর্জন ধ্বনিত হলো। এতেই একালাবাসী বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। অতঃপর জিবরাঈল (আ.) তার পাখার একটি কোণের আঁচড়ে সম্পূর্ণ বসতি উল্টে দিলেন। এরপর প্রস্তর নিক্ষেপ করে তাদের নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে দেয়া হলো। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘সূর্যোদয়ের সময় তাদের এক ভয়ংকর গর্জন পাকড়াও করল। অতঃপর আমি সেই জনপদটি উল্টে দিলাম এবং তাদের ওপর বর্ষণ করলাম কঙ্করের প্রস্তর। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীলদের জন্য রয়েছে নির্দশন।’ (সূরা হিজর : ৭২-৭৪)।
অতীতে অবাধ্য জাতিগুলোর শাস্তির মধ্যে কওমে লুতের শাস্তি ছিল মারাত্মক। তাদের শাস্তির ধরন ছিল তিনটি। যথা ১. বিকট বজ্র দ্বারা মৃত্যু। ২. মৃত্যুর পর বসতি উল্টে দেয়া। ৩. এরপর প্রস্তর বর্ষণ।
মৃত সাগর : কওমে লুতের ধ্বংসলীলার জীবন্ত সাক্ষী
আল্লাহ তায়ালা অতীতের অবাধ্য, পাপিষ্ঠ জাতিগুলো সমূলে ধ্বংস করে পরবর্তীদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন, যাতে সেসব জাতি পাপ ও অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটায় পৃথিবীতে। পবিত্র কোরআনে কওমে আদ, কওমে সামুদ, কওমে লুত, ফেরাউন, কারুণের করুণ পরিণতির কথা বারবার আলোচিত হয়েছে। তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের উপদেশ দেয়া হয়েছে। আজও পৃথিবীতে তাদের ধবংসাবশেষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। জর্ডানে অবস্থিত উবধফ ঝবধ বা মৃত সাগর অভিশপ্ত সমকামী কওমে লুতের ধ্বংসলীলার জীবন্ত সাক্ষী।
ঐতিহাসিকদের মতে, এককালে এ স্থানটি শুষ্ক জনপদ ছিল। সামুদ ও আমুরা সম্প্রদায় বাস করত সেখানে। জিবরাঈল (আ.) সম্পূর্ণ এলাকাটিকে উপরে উঠিয়ে তা ছেড়ে দেন। ফলে ৪২০ মিটার নিচে চলে যায় এবং নিচের পানি উপরে উঠে আসে। এভাবে জনপদটি সমুদ্রের রূপ পরিগ্রহ করে। প্রাচীন যুগে এটিকে বাহরে লুত বা লুত সাগর বলা হতো। এর পানি অত্যধিক লবণাক্ত বিধায় তাতে মাছ বা অন্য কোনো জীবিত প্রাণী থাকতে পারে না। সমকামিতার অভিশাপ হয়ে সাগরটি আজও পৃথিবীতে বহমান। যাতে পৃথিবীবাসী কওমে লুতের এ ভয়াবহ শাস্তি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সমকামিতার মতো নিকৃষ্ট অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার সাহস না পায়। কিন্তু অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, আজ পৃথিবীজুড়ে সেই অভিশপ্ত সমকামিতার আওয়াজ উচ্চকিত হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বে এর সামাজিক বৈধতার জন্য আন্দোলন হচ্ছে এবং কোনো কোনো আইন বৈধতাও লাভ করেছে। সেসব দেশে সমকামী বিয়ের ঘটনা অহরহ ঘটছে, আল্লাহতে বিশ্বাসী মানুষ যাতে বিচলিত না হয়ে পারেন না। নতুন কোনো আজাবের আশঙ্কায় আমরা আতঙ্কিত ও চিন্তিত।
সমকামিতার অভিশাপ
সমকামিতা একটি ভয়াবহ অভিশাপ। পশ্চিমা বিশ্বে পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে যায় যেসব কারণে, তার অন্যতম এ সমকামিতা। এ কুকর্মটি শারীরিক অসংখ্য রোগ-ব্যধির মূল উৎসও বটে। এইডস থেকে শুরু করে পায়ুপথ ও যৌনাঙ্গের অসংখ্য রোগের সবচেয়ে বড় কারণ। বিশ্বের কোনো সুস্থ সমাজে এ বিকৃত যৌনাচারের সামাজিক বৈধতা নেই। এমনকি বিভিন্ন দেশে এ ঘৃণিত অপরাধের জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনেও সমকামিতা একটি দ-নীয় অপরাধ। অপরাধ প্রমাণিত হলে যাবজ্জীবন বা ১০ বছর কারাদ- ও অর্থদ-ের বিধান রয়েছে।
পবিত্র ইসলাম সমকামিতাকে ব্যভিচার আখ্যা দিয়ে এর কঠিন শাস্তির বিধান আরোপ করেছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা যদি কাউকে লুত সম্প্রদায়ের কুকর্মে (সমকামিতায়) লিপ্ত দেখ, তাহলে কর্তা ও কৃত উভয়কে হত্যা করে ফেল।’ (তিরমিজি : ১১৭৬; আবু দাউদ : ৩৫৫)।
সাহাবা, তাবেঈন ও মুজতাহিদ ইমামরা সমকামীদের কঠিন শাস্তির পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ এবং ইমাম শাফেয়ি (রহ.) এর বিশুদ্ধতম অভিমত হচ্ছে, সমকামীকে ব্যভিচারের শাস্তি দেয়া হবে। ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ ও অন্যান্য আলেমের মতে কর্তা ও কৃত উভয়কে হত্যা করা হবে। সমকামিতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ অস্বাভাবিক কুরুচিপূর্ণ যৌনাচার। এটি আল্লাহ তায়ালার সিস্টেমের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ। পশু সমাজেও এই নিকৃষ্ট কর্মটির উপস্থিতি দেখা যায় না। পশুরাও যৌনক্ষুধা নিবারণের জন্য বিপরীত লিঙ্গের দ্বারস্থ হয়। অতএব, আশরাফুল মাখলুক হয়ে সমলিঙ্গের সঙ্গে যৌনকাজ সম্পাদন করলে এ রকম কঠিন শাস্তি হওয়াই সমীচীন।