নিউজ ডেস্ক:
খুব বেশি দিন হয়নি, ভিয়েতনাম ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। ১৯৮৬ সালে তারা ‘দোই মোই’ (সংস্কার) প্রক্রিয়া শুরু করে। এর আওতায় ব্যক্তি মালিকানার প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৃহত্তর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। বিদেশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় ভিয়েতনামের অর্থনীতি। দেশটিতে শ্রমিকদের নিম্নমজুরি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সরকারের বিশাল ট্যাক্স ছাড় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সহায়তা করে।
বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এই দেশটি কীভাবে গত ৩০ বছরে নিজেদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছে, তা যেন এক গল্প। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সংঘটিত একটি দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সংঘাতের নাম ছিলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এটি দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ নামেও পরিচিত। প্রায় ২০ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের প্রভাবে ভিয়েতনামের অর্থনীতি একেবারেই ভেঙে পড়ে। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র অর্থনীতির দেশ হয়ে পড়ে ভিয়েতনাম।
১৯৭৬ সালে দুই ভিয়েতনাম এক হওয়ার পর উত্তর ভিয়েতনাম ধীরে ধীরে তার পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গোটা ভিয়েতনামের ওপর প্রয়োগ করে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে দেশটির মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৩১ ডলার। আর বর্তমানে তাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৩৫০০ ডলারের মত।
১৯৮৪ সালে দেশটির জিডিপির আকার ছিল মাত্র ১৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের। তবে ১৯৮৬ সালে এসে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। ওই বছর দেশটির সরকার (কমিউনিস্ট পার্টি অব ভিয়েতনাম) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার প্রকল্প হাতে নেয়। ‘আইএমআই’ সংস্কার প্রকল্প প্রবর্তনের মাধ্যমে ভিয়েতনামকে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ হিসেবে পরিচালিত করে সরকার। এখন সেই ভিয়েতনাম বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর একটি। বর্তমানে চীনের সঙ্গে প্রবৃদ্ধিতে টেক্কা দিচ্ছে দেশটি।
আশ্চর্যজনকভাবে ভিয়েতনামের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে চীনের অতীত পরিকল্পনার যথেষ্ট মিল দেখা যায়। ভিয়েতনামের অন্যতম আয়ের উৎস তৈরি পোশাক রফতানি খাত। এই খাত দেশটির অর্থনীতির মেরুদণ্ড হতে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের বিখ্যাত সব ব্র্যান্ড দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় নতুন উৎপাদনকারী খুঁজছে। কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে করোনা মোকাবিলায় সফল ভিয়েতমান এখন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের কোম্পানিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ও ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংসের মতে, ভিয়েতনামের উন্নয়নযাত্রায় তিনটি বিষয়ের অবদান রয়েছে। প্রথমত, দেশটি নিজেদের আগ্রহের সঙ্গে মিল রেখে বাণিজ্য উদারীকরণ করেছে। দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রণ না করে এবং ব্যবসা শুরুর ব্যয় কমিয়ে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের সঙ্গে ও বাহ্যিক উদারীকরণকে পরিপূরক করেছে দেশটি। আর সর্বশেষ, ভিয়েতনাম নিজেদের মানুষের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। গড়ে তুলেছে মজবুত অবকাঠামো।
গত ২০ বছরে অসংখ্য মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করেছে ভিয়েতনাম। ১৯৯৫ সালে আসিয়ানভুক্ত হয় ভিয়েতনাম। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করে তারা। ২০০৭ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যোগ দেয় ভিয়েতনাম। চীন, জাপান, কোরিয়া ও ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে দেশটির। এসব চুক্তির প্রভাবে আমদানি ও রফতানি দুই ক্ষেত্রেই ধীরে ধীরে কিছুটা শুল্কছাড় সুবিধা পেতে শুরু করে ভিয়েতনাম। মুক্ত অর্থনীতি তৈরির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সংস্কারও চালিয়ে যায় ভিয়েতনাম সরকার।
গত ৩০ বছরে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে ভিয়েতনাম। ফলে জনসংখ্যা কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি দেশটির জন্য। জনসাধারণের জন্য সস্তায় ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে দেশটি। এতে প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির দরজায় কড়া নাড়ছে এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে আইটি অবকাঠামো স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং বাজারবান্ধব নীতির কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ এবং উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে ভিয়েতনাম। তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি ইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরির বড় বড় কোম্পানিও ভিয়েতনামে কারখানা স্থাপন করেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষুদ্র একটি কৃষিপ্রধান দেশ ছিল ভিয়েতনাম। যার আয়তন প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। ছোট এই দেশটিই এখন প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক উন্নতি করেছে। ভিয়েতনামের বেসরকারি এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে ৬ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে ইন্টারনেট সেবার আওতায় এনেছে দেশটি। যা ২০১৭ সালের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি। সাড়ে নয় কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে মোবাইল সাবস্ক্রিপশনের সংখ্যা ১৪ কোটি ৩৩ লাখ।
দেশটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে দেশটির ডিজিটাল ইকোনমির বাজার ছিল ৩০০ কোটি ডলার। ২০১৯ সালে এসে তা ৯০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। আর ২০২৫ সাল নাগাদ তা ৩ হাজার বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে মনে করছে দেশটি।
তৈরি পোশাকের রফতানি বাজারে কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে সক্ষমতার জানান দিয়ে আসছিল ভিয়েতনাম। অবশেষে দেশটির রফতানি কৌশলের কাছে হার মেনেছে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাকের রফতানি বাজারে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে ভিয়েতনাম এখন দ্বিতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ।
গত অর্থবছর তৈরি পোশাক থেকে ভিয়েতনামের রফতানি আয় এসেছে ৩০ বিলিয়ন ৯১ কোটি ডলার। যেখানে বাংলাদেশের এসেছে ২৭ বিলিয়ন ৯৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনামের আয় প্রায় ৩ বিলিয়ন (২৯৬ কোটি ডলার) ডলার বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানিতে চীনের উদ্যোক্তাদের একক আধিপত্য দীর্ঘদিনের থাকলেও করোনা মহামারি শুরুর হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রফতানি কমে যায়। চলতি বছরের চার মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পোশাকের রফতানি হ্রাস পেয়েছে ৪৬ শতাংশ। ফলে করোনার আশীর্বাদে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানিতে চীনকে পেছনে ফেলে এখন শীর্ষস্থান দখলে নিয়েছে ভিয়েতনাম।
জাপানের আর্থিক প্রতিষ্ঠান নমুরার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ইউরোপ এবং আমেরিকার কোম্পানিগুলোর গন্তব্য এখন পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই রয়ে গেছে। গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, চীন থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৬টি কোম্পানি তাদের ব্যবসা সরিয়ে নিয়েছে। এরমধ্যে ২৬টি ভিয়েতনামে, ১১টি তাইওয়ানে, থাইল্যান্ডে আটটি এবং ভারতে মাত্র তিনটি কোম্পানি গেছে।
এছাড়া পূর্ব-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানে তৈরি পোশাক উৎপাদন ব্যয় খুবই কম। বিদেশি বিনিয়োগ টানতে ভিয়েতনাম সরকার ট্যাক্স হ্রাসসহ বিভিন্ন ধরনের ছাড় দিয়েছে। এসবও দেশটিতে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
করোনা সঙ্কট শুরুর পর দেশটির পোশাক শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে শ্রমিকরাও প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন। শ্রমিকরা ঘোষণা দিয়েছেন, দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে ও নিজেদের স্বার্থে বর্তমানে অতিরিক্ত সময় কাজ করলেও সেজন্য আলাদা কোনও মজুরি তারা নেবেন না। এতে উৎপাদন যেমন বাড়বে তেমনই কমে আসবে উৎপাদন ব্যয়ও। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মন জয়ে ভিয়েতনামের শ্রমিকদের অভিনব এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
করোনা মহামারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি যখন নাকানি-চুবানি খাচ্ছে তখন ভিয়েতনামের বাণিজ্য বিস্ফোরণ ঘটছে। দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের আশপাশে। করোনমুক্ত হওয়ায় এখন চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বিনিয়োগকারীরা চলে আসছেন ভিয়েতনামে।
হ্যানয়ের ভিয়েত ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজের কর্মকর্তা লুয়ং হোয়াং বলেন, সাম্প্রতিক সময় স্থিতিশীল অর্থনীতি ভিয়েতনামের নতুন আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। ডলারের তুলনায় ভিয়েতনামিজ ডং মোটামুটি স্থির রেখেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে এক অংকের ঘরেই। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ধারাও অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছর বড় বিনিয়োগ এসেছে চীন, হংকং ও সিঙ্গাপুর থেকে। এছাড়া, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও প্রযুক্তি লড়াইয়ে ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোরও অন্যতম গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছে ভিয়েতনাম।